ঈদুল আযহা ও কোরবানির শিক্ষা
মোহাম্মদ আবু তাহের ॥ ঈদুল আযহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোকনা কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী সৌন্দর্যের বন্দনে আবদ্ধ হয়ে আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ন মর্মবানী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় “সকলের তরে সকলে আমরা” এ মর্মবানী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরনা জোগায়। এ প্রেরনায় উদ্দীপ্ত সমাজের হত দরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, মুসলমান হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারেন একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আযহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব। ঈদুল আযহা কোরবানি বা ত্যাগের ঈদ। কোরবানী মানে শুধু পশুহত্যা নয় মনের পশু হত্যা করার দিন। চার হাজার বছর এর বেশী আগে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মহান আল্লাহ্ -তায়ালার নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস অর্থাৎ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহ্-তায়ালার অপার কুদরত ও মহিমায় হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই থেকেই চালু হয় কোরবানিতে পশু জবাই করার বিধান। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহ্র অনুগ্রহ কামনা করে পশু কোরবানি করেন। সামর্থবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ফরজ। ঈদের পরের দুই দিনও পশু কোরবানি করা যায়। ঈদ নামায শেষে করতে হয়। কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্যে, আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এক ভ্াগ এবং গরীব মানুষদের মধ্যে একভাগ বন্টন করে দেয়া উত্তম। ইসলাম শব্দের অর্থের সাথে কোরবানির এক অভিন্ন মিল খুজে পাওয়া যায়। ইসলাম অর্থই হচেছ আত্মসমর্পন এবং আত্মসমর্পন এর অর্থ হচ্ছে আত্মবিসর্জন, আর আত্মবিসর্জন মানেই কোরবানি। রাসুল (আঃ) এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তির কুরবানি করার সামর্থ আছে আর সেই ব্যক্তি যদি কোরবানি না করে সে যেন ঈদগাহে না আসে। সামর্থবান মানে যিনি নিছাব পরিমান সম্পদের মালিক হবেন তার উপর কোরবানি করা বাধ্যতামূলক বা ওয়াজিব। কোরবানির গুরুত্ব বিষয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত হাদিসে রয়েছে হযরত রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন ‘কোরবানির দিনে কোরবানির চেয়ে কোন আমল আল্লাহ্-তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় নয়। কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুর শিং, লোম ও পায়ের খুর সব কিছু নিয়েই আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে। কোরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মহান আল্লাহ্-তায়ালার কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌছে যায়। সুতরাং তোমরা স্বাচ্ছন্দে কোরবানি কর’। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে কোরবানিকৃত পশুর গোশত এবং রক্ত কিছুই আল্লাহ্র কাছে পৌছায় না বরং পৌছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া (সুরাঃ হজ্ব-৩৭) অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে আল্লাহ্ তো কেবল মুক্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন (সুরাঃ কায়দা-২৭)। সুরা কাওসার এর ২নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে অতএব তোমার মালিককে স্মরণ করার জন্য তুমি নামাজ পড় এবং (তারই উদ্দেশ্যে) তুমি কোরবানি করো। কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। হযরত ইসমাইল (আঃ) যখন তরুন বয়সের আল্লাহ্ পাক ইব্রাহীম (আঃ) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন হে ইব্রাহীম আমি আল্লাহ্র ভালবাসায় তোমার ইসমাইলকে কোরবানি কর। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছেলে ইসমাইল (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন হে প্রিয় ছেলে আল্লাহ্ আমাকে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দিলেন আল্লাহ্কে ভালবেসে তোমাকে জবাই করে কোরবানি করে দিতে। এবার তুমি এ ব্যাপারে তোমার মতামত জানাও। ছেলে ইসমাইল বলেন আমি জবাই হলে যদি আল্লাহ্ রাজি ও খুশী হয়ে যান তাহলে হাসিমুখে আল্লাহ্র পথে জবাই হতে রাজি আছি। পিতা যখন পুত্রকে জবাই করার জন্য শুয়ালেন তখন আল্লাহ্-তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষনা এলো আমি তোমার ছেলের রক্ত, গোশত চাইনা, আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি এখন অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে তুমি কোরবানি করো। আল্লাহ্ তায়ালা দুম্বা পাঠালেন এবং ইব্রাহীম (আঃ) অনুষ্টান পালনের কোরবানি করলেন। কাজেই কোরবানি কোন অনুষ্টান নয়, কোরবানি হলো পশুর সঙ্গে পশুত্ব কোরবানির নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে অনেকে অনেক মানসিকতায় কোরবানি করেন যা সহজেই দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ লোক লজ্জায় নিজে কোরবানি না দিলে সন্তানরা গোশত পাবে কোথায়, আশপাশের অনেকেই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দেই কিভাবে- এ ধরনের মানসিকতায়ও কোরবানি করেন। এ ধরনের কোরবানি আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে না ও পৌঁছাতে পারে। তাছাড়া অনেক বিত্ত বৈভবের মালিকগণকে কত দামের কোরবানি করবেন সে প্রতিযোগিতায় সামিল হতে দেখা যায়। তাদের কাছে কোরবানি লৌকিক প্রথা হয়ে গেছে। লক্ষাধিক টাকায় গরু বা উঠ কিনে বাসার গেটের সামনে বেধে রেখে নিজ এলাকায় খ্যাতি অর্জনই অনেকের কোরবানির উদ্দেশ্য বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ ধরনের কোরবানি দ্বারা আত্মত্যাগ হয়না। ঈদুল আযহার দিনে পশু কোরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জল হউক আমাদের জীবন তা না হলে সামর্থবান মুসলমানদের কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কোরবানীর মূল তাৎপর্য হলো আল্লাহর আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানী শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কোরবানীর মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ্ আমাদের সত্যিকারের কোরবানি করার তৌফিক দান করুন।
মন্তব্য করুন