ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূঁজা ও মেলা অনুষ্ঠিত

ইমাদ উদ দীন॥ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রেমনগর চা বাগানে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূঁজা ও মেলা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৪ এপ্রিল শুক্রবার বিকালে সম্পন্ন হয়েছ। ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূঁজা ও মেলার এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রেমনগর চা বাগান আশেপাশের এলাকার মানুষের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলো বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জানান, চড়ক পূঁজা উৎসবের ১০-১২ দিন আগে থেকে বিভিন্ন এলাকার পূঁজারীর মধ্যে ৪০-৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী সহ নৃত্যগীত সহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। এ ক’দিন তারা পবিত্রতার সহিত সন্যাস ব্রত পালন করে নিরামিষ ভোজি এবং সারাদিন উপবাস পালন করেন। চড়ক পূজার ২ দিন পূর্বে পূঁজারীরা শ্মশানে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করেন গোটা এলাকা।
ভক্তরা নৃত্য করার জন্য কলাগাছ ও বাঁশের খুটি বেষ্টিত মন্ডলী তৈরী করে। পূঁজার প্রথম দিন নিশি রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র ধারা কাচ পড়া দিয়ে জলন্ত ছাইয়ের উপর মানুষরুপি কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তগণ নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোলক, কাশি, করতাল বাজিয়ে থাকেন। এসময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি এবং নারীদের কন্ঠে হুলুদ ধ্বনি দিতে থাকেন। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে ৭টি বলিছেদ (লম্বা দা) এর উপর শিব শয্যা করেন। শিবের উপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রুপ ধারন করেন। কালীকাঁচ শেষ হওয়ার পর সকালে পূঁজারীরা পূঁজা করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানানো হলে পার্শ্ববর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘী থেকে ভেসে উঠে ১০০ ফুট লম্বা চড়ক গাছ। এ গাছের চুড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাধা হয় চারটি বড় বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় বড় লম্বা রশি। আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘীতেই ডুবিয়ে রাখা হয়ে ছিল চড়ক গাছ। দিঘীর পাড়ে গর্ত খুড়ে সোজা এবং খাড়া করে পোঁতা হয় এ গাছ। প্রেমনগর চা বাগানে ওই দিন দুপুর থেকে নারী পুরুষ দর্শনার্থীর বিশাল সমাগম ঘটে। বিকেল বেলায় ভক্তদের মন্ডলীতে বিশাল দা (বলিছেদ) দিয়ে নৃত্য, শিবের নৃত্য ও কালীর নৃত্য দেখানো হয়।
নৃত্য শেষে ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘীতে স্নান করে ভক্তদেরকে লোহার শিকড় শরীরের বিভিন্ন অংশে পিষ্ট (গাঁথা) করা হয়। বিশেষ করে জিহ্নবা ও গলায় গেঁথে দেয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহ্নে মূল সন্ন্যাসী ৪ জন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দু’টি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। এ সময়ে দর্শনার্থীদের অনেকে বাতাসা আর কলা উপর দিকে উড়িয়ে দেন আর দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন।
চড়ক পূঁজা উপলক্ষে বসেছিল বিশাল গ্রামীণ মেলা। মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন রকমারী জিনিসপত্রের পসরা ছিল। যুগ যুগ ধরে এ চড়ক উৎসব এ অঞ্চলের হিন্দুদের বেশ নাড়া দিয়ে আসছে। বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দু’দিন ও ১লা বৈশাখ বসে মেলা। শেষ চৈত্রের গোধুলীলগ্নে চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে ঘোরানো হয়। এর আগে ভক্ত ও পূঁজারীরা চড়ক গাছে ফুল, দুধ ও চিনি দিয়ে পূঁজা দেয়। মৌলভীবাজারের প্রেমনগর চা বাগানের ম্যানেজার লিটন দেওয়ান বাহা উদ্দিন জানান, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ছিল। তিনি সকলের সহযোগীতায় পূঁজা ও মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করায় সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
মন্তব্য করুন