কমলগঞ্জের মণিপুরী মহারাসলীলা উৎসবে হাজার হাজার মানুষের উপচে পড়া ভিড়

November 24, 2018,

প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ॥ বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শনিবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা।  কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে এ কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ রাসোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার ঊষা লগ্নে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর যার যার নিজ নিজ গন্থব্যস্থলে চলে যান। মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়েছিল কমলগঞ্জের মণিপুরী অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে পুলিশ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।

দামোদর মাস খ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৬ তম মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে ২৩ নভেম্বর শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি প্রকৌশলী যোগেশ্বর সিংহের ও সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক চিফ হুইপ ও সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহীদ এমপি। গেষ্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত অষ্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার মিসেস জুলিয়া নিবলেট। অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মণিপুরী সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। রাত ১২টা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ।

অপরদিকে রাসোৎসব ২০১৮ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আদমপুর মণিপুরী কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মীতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের ৩৩ তম রাস উৎসবে উপলক্ষ্যে রাত ৮টায় অয়োজিত গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্টানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক চিফ হুইপ ও সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহীদ এমপি। উৎসব কমিটির আহবায়ক শৈলবাবু সিংহের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব এ হেমন্ত সিংহ ও কবি সনাতন হামোমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গুণী ব্যক্তি হিসেবে লে: কমান্ডার খোইরোম লেইশেম, অরুপ রতন সিংহ ও রিপন কুমার সিংহকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি এম, মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক, জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ তফাদার রিজুয়ানা ইয়াসমিন (সুমি), আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো: আবদাল হোসেন, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব এর সাধারণ সম্পাদক সালেহ এলাহী কুটি, প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হামোম তনুবাবু প্রমুখ। এদিকে আদমপুর নয়াপত্তন যাদু ঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী সাংস্কৃতিক পরিষদের আয়োজনে (মীতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের) ৩য় বারের মতো রাস উৎসব নানা কর্মসুচীর মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এখানে রাত সাড়ে রাত ১১টা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা উৎসব। ভোরের সূর্যোদয়ের পর অনুষ্টানের পরিসমাপ্তি ঘটে এই মহামিলন অনুষ্টানের।

 ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্ন দৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তাহাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহন করতেন। এর ফলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রুপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা। তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই আজকের দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।

১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছিল রাসোৎসবের প্রস্তুতি।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com