কুলাউড়ায় রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বালু পরিবহনে বাঁধার অভিযোগ

মাহফুজ শাকিল : কুলাউড়ায় মনু নদের ওপর কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর সড়কে ‘রাজাপুর সেতু’ নির্মাণের কাজ প্রায় তিন বছর ছয় মাস আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ না হওয়াতে এ সেতু দিয়ে যান চলাচল এখনো শুরু হয়নি। এ প্রকল্পের মেয়াদে কাজ প্রায় সাড়ে তিন বছরে এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। এদিকে রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কের জন্য বালু পরিবহনে বাঁধার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে।
সওজ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়ন পৃথিমপাশা, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে গত ২০১৮ সালে রাজাপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয়। পরে সওজ অধিদপ্তর মনু নদের ওপর রাজাপুর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
প্রকল্পে ‘কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর সড়কের ১৪তম কিলোমিটারে ২ শত ৩২ দশমিক ৯৪ মিটার পিসি গার্ডার সেতু, সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও জমি অধিগ্রহণ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯ কোটি ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
৩৪ কোটি টাকায় ব্যয়ে সেতু নির্মাণে ‘জন্মভূমি-ওয়াহিদুজ্জামান-নির্মিতি’ নামের সিলেটের যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ করে। ২০২০ সালে কার্যাদেশ পাওয়া প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর দুই পাশে সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ পায় ‘ মেসার্স মোঃ জামিল ইকবাল’ নামের সিলেটের আরেকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভুমি অধিগ্রহণে নানা জটিলতা থাকায় পরবর্তীতে দুই দফায় কাজের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানা হয়েছে।
এদিকে রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কসহ সরকারী উন্নয়নমূলক কাজের জন্য উত্তোলনকৃত বালু পরিবহনে বর্তমান ইজারাদার কর্তৃক বাধার অভিযোগ এনে গত ৩ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দেন মনু নদী থেকে বালু উত্তোলনের সাবেক ইজারাদার মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর দীপক দে। ওই অভিযোগের পর প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার সহকারী কমিশনার ফাতেমা তুজ জোহরা স্বাক্ষরিত একটি একটি চিঠি গত ৫ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে দেয়া হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসক বরাবরে পৃথক আরেকটি অভিযোগ দেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মোঃ জামিল ইকবাল। পৃথক অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ১৪৩০ বাংলা সনে কুলাউড়া মনু নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল ইজারাপ্রাপ্ত হন দীপক দে।
সরকারি নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের লক্ষে ঠিকাদার মেসার্স মোঃ জামিল ইকবালের কাছে মনু নদী থেকে উত্তোলনকৃত সম্পূর্ণ বালু বিক্রয় করেন। বিভিন্ন সরকারী উন্নয়ন কাজের মধ্যে মেগাপ্রকল্প ঢাকা-সিলেট ৬-লেন জাতীয় মহাসড়ক, রাজাপুর সেতুর এপ্রোচ নির্মাণ প্রকল্প ও সিলেট, মৌলভীবাজার,হবিগঞ্জ জেলায় সরকারী অনেক প্রকল্পে রাস্তা ভরাটের কাজে বালু সরবরাহের জন্য কুলাউড়া উপজেলার কটারকোনা মৌজার সালন গ্রাম এবং কাউকাপন মৌজার হরিরচক ও সাধনপুর গ্রামে বালু উত্তোলন করা হয়।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মোঃ জামিল ইকবাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি চুক্তিভিত্তিক লিজ নিয়ে স্টেক ইয়ার্ড নির্মাণ করে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরীকৃত বেরিবাধ সংলগ্ন রাস্তা ব্যবহার করে প্রকল্প এলাকায় বালু পরিবহনের জন্য অনুমোদন পেতে বিলম্ব হওয়ায় এবং প্রকল্প এলাকা রাজাপুর-চাতলাপুর সংযোগ সড়কে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা থাকায় ১৪৩০ বাংলা সনে উত্তোলনকৃত বালু নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সময়মত সরকারী প্রকল্প এলাকায় নিতে পারেননি।
বালু উত্তোলনের নির্ধারিত সময় পার হলে পরবর্তী বছরের জন্য খালেদ আহমদ নামের এক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বালু উত্তোলনের ইজারা প্রদান করা হয়।
বর্তমানে সড়কের অধিকাংশ জায়গায় অধিগ্রহণ কাজ শেষ হওয়ায় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমোদন পাওয়ায় উত্তোলিত বিক্রয়কৃত বালু সরকারী উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে এবং বালু পরিবহন করতে নতুন ইজারাদার ও কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ খালেদ আহমদ, তার সহযোগী ইউপি সদস্য কিবরিয়া হোসেন খোকন, জয়পাশার বাসিন্দা ফয়জুল হক লিটন, কটারকোনার বাসিন্দা খসরু মিয়া, আমানীপুরের বাসিন্দা ময়না মিয়া বাধা ও হমকি প্রদান করছেন। যার ফলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জামিল ইকবাল বিপুল পরিমাণ বালু সরকারী উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করতে এবং পরিবহন করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে রাজাপুর-চাতলাপুর সংযোগ সড়কের কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হচ্ছে এবং অন্য সরকারী উন্নয়নমূলকও কাজ থমকে আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আতাউর রহমান বাবলু, গিলমান আলী বলেন, প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে রাজাপুর সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলেও সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়নি। এ প্রকল্পে সংযোগ সড়কে কিছু বালু ভরাট করলেও বালু উত্তোলনে সৃষ্ট জটিলতার কারণে সংযোগ সড়কের কাজে বিলম্ব হচ্ছে।
গ্রামবাসীরা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান,বালু ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কাজ শেষ করার তাগিদ দিলে তারা শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে কয়েক হাজার লোককে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর আবেদন জানাচ্ছি।
বালু উত্তোলনের সাবেক ইজারাদার দীপক দে বলেন, সরকারী উন্নয়নমূলক কাজে রয়েলটি প্রদান করে ইজারা গ্রহণ করি। কিন্তু দেড় কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করার পর সেই বালু সরকারী নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের জন্য রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কের ঠিকাদার জামিল ইকবালের কাছে বিক্রয় করি।
বর্তমান ইজারাদার খালেদ আহমদ গংয়ের বাঁধা ও হমকির কারণে বালু পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে ঠিকাদারী প্রতিষ্টান জামিল ইকবাল বিপুল পরিমাণ বালু রাজাপুর সেতুর সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন সরকারী উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
বালু পরিবহনে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বর্তমান ইজারাদার খালেদ আহমদ বলেন, জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে বিধি মোতাবেক বর্তমান সনে আমি বালু উত্তোলনের ইজারাপ্রাপ্ত হই। মনু নদীর নির্ধারিত ঘাট থেকে আমরা বালু উত্তোলন করে যেখানে বালু রাখবো সেই স্থানে পূর্বের ইজারাদার দীপক দে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে বালু স্তুপ করে রেখে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো কোন সুরাহা পাইনি।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘জামিল-ইকবাল’ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার সাইফুল আহমদ বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও বালু পরিবহনে বাঁধার কারণে কাজ বন্ধ আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন জানান, বালু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় সাবেক ইজারাদার ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির বিষয়টি আমাদের জানার বিষয় না। তবে বিভিন্ন স্থানে উত্তোলন করা স্তুপকৃত বালুর বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে থেকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন