কুলাউড়ায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা

August 9, 2024,

কুলাউড়া প্রতিনিধি॥ কুলাউড়ায় পৌর শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এছাড়া শহর পরিষ্কারের জন্য কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাজ চালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এদিকে চলমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মহি উদ্দিন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহরুল হোসেন, সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আদনান, মেজর রিয়াদ, উপজেলা বিএনপির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সজল, সাংগঠনিক সম্পাদক সুফিয়ান আহমদ, উপজেলা জামায়াতের আমীর আব্দুল হামিদ, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুন্তাকিম, ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আখইসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ।

সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা, যেকোন সহিংসতা রক্ষায় সম্মিলিতভাবে কাজ করা, নতুন সরকারের শপথ নেয়ার পর প্রত্যেক ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াতের স্বমন্বয়ে কমিটি করে সকল মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপসানালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।

জানা যায়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে থানা ও সড়ক ছাড়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। এরপর থেকে গত তিনদিন যাবৎ শহরে কোনো ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা, কুলাউড়া উপজেলা স্কাউট, নবীন চন্দ্র স্কাউট দল লংলা শতাব্দী রেলওয়ে মুক্ত স্কাউট, কুলাউড়া মুক্ত স্কাউট গ্রুপ, কুলাউড়া সরকারি কলেজ রোভার দলসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে গত মঙ্গলবার শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করেন কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এসময়  অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলের হাতেই প্লাস্টিকের ঝুঁড়ি ও বেলচা ছিল।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর কুলাউড়ায় ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে পতাকা হাতে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করে বিজয় মিছিল করে। পৌর শহরের স্কুল চৌমুহনী পয়েন্ট থেকে উত্তর বাজার মিলিপ্লাজা মার্কেটের সম্মুখ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে ওই বিজয় মিছিলে। বিজয় উল্লাসে নানা স্লোগানে মুখরিত হয় কুলাউড়ার রাজপথ। এসময় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বিরোধী নানা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসসহ বিভিন্ন অফিস, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এরই মাঝে বিক্ষুব্ধ জনতা উত্তেজিত হয়ে কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষ, পৌরসভা কার্যালয়, থানা পুলিশের কার্যালয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে।

পরে বিকেল ৪টায় কুলাউড়া থানায় শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা প্রবেশ করে থানা পুলিশকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বিকেল ৪ টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত থানার ভিতরে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে অবরুদ্ধ ছিলেন সার্কেল, ওসিসহ থানার পুলিশ সদস্যরা। একপর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুলাউড়া সার্কেল দীপঙ্কর ঘোষের সরকারি গাড়ি ও এক পুলিশ সদস্যের মোটরসাইকেল পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। পরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আলী মাহমুদের সরকারি গাড়ি, পুলিশ সদস্যদের বসার বিভিন্ন কক্ষ, পুলিশ সদস্যদের ২০-২৫টি মোটরসাইকেল ভাংচুর ও বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করা হয়। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রবেশ করে ভাংচুর করার পর জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, শহরের দক্ষিণ বাজারে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ভাংচুর করে কমপ্লেক্সে ভাংচুর করা হয়। পরে শহরের দক্ষিণ বাজারে অবস্থিত উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমানের মালিকানাধীন মিতালি ফার্মেসি ভাংচুর করে সমস্ত ঔষধ লুট করা হয়। এরপর উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র সিপার উদ্দিন আহমদের বাড়িতে হামলা করার পর তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করা হয়। এছাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সায়হাম রুমেলের বাড়িতে হামলা ও গাড়িতে ভাংচুর করা হয়।

এরপর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান হোসেন আল নাহিয়ানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরশদ ক্লথ স্টোরে হামলা ভাংচুর করে সকল কাপড় লুটপাট করা হয়। বিকেল ৩ টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত থানা পুলিশের অফিসের সামনে বিভিন্ন স্লোগান দেন বিক্ষুব্দরা। পরে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পুরো পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে আসলে বিক্ষুদ্ধ জনতা শহর ত্যাগ করে চলে যান। রাত ৮টার পর থানার সম্মুখে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বিক্ষুব্দ জনতার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, সোমবার বিকেল ৩টার আগ পর্যন্ত যে সরকার ছিল সেই সরকারের অধীনে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন যে সরকার গঠন হবে আমি সেই সরকারের অধীনে আমার সরকারি দায়িত্ব পালন করবো। আমার অতীত দায়িত্বকালীন সময়ে যদি কোন ভুল করে থাকি তাহলে আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। এসময় তিনি আরো বলেন, অতীতে যদি কারো ওপর উদ্দেশ্যে প্রণোদিত কোন মামলা হয়ে থাকে তাহলে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে গত ৫ আগস্ট রাতেই সকল পুলিশ সদস্যরা তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে থানা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। এরপর থেকেই জনশূন্য হয়ে পড়ে কুলাউড়া থানা পুলিশ। শহরের যান চলাচলের সময় কোন পুলিশ সদস্যকে সড়কে দেখা যায়নি। ভঙ্গুর হয়ে পড়ে সড়কের শৃঙ্খলা। এমতাবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নেন কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন স্কাউটগ্রুপসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের এই কার্যক্রমকে সুধী সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ স্বাগত জানিয়ে ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন।

ট্রাফিক ও শহর পরিষ্কারে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীন, ময়নুল ইসলাম, ফরহাদ আহমদ, সাগরসহ অনেকেই জানান, আমাদের শহর আমাদেরই পরিষ্কার করতে হবে। এজন্যই আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি অংশ নিয়েছি। শহরের যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশিং কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা কিছুটা হলেও ফেরাতে পারলে আমরা আনন্দ পাচ্ছি। এ কার্যক্রমে সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, এখন জেলায় মিটিংয়ে আছি। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে খুবই দ্রত সময়ের মধ্যে থানার সকল পুলিশ সদস্যদের নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করবো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মহি উদ্দিন বলেন, চলমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, সম্মিলিতভাবে দল-মত নির্বিশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবাইকে কাজ করতে হবে। দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদের যাতে আর কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য সর্বস্তরের মানুষকে নজরদারি রেখে সচেতন থাকার আহবান জানানো হয়েছে। স্কাউটসহ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের চলমান সংকটের সময় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা যে কার্যক্রম করে যাচ্ছেন তা খুবই প্রশংসনীয়।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com