চা উৎপাদনে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

January 28, 2019,

স্টাফ রিপোর্টার॥ চা উৎপাদনে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। চা চাষের ইতিহাসে এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে চা শিল্প। প্রতিকূল আবহাওয়ায় শুরু ২০১৮ সালে চায়ের এমন উৎপাদন রেকর্ড সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার চা –শিল্পের জন্য সুখবরই বটে।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ১৬৬ টি চা– বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারেই ৯২টি চা বাগানের অবস্থান। বাকীগুলো হচ্ছে হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২ টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৯ একর।

চা গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে চা বাগানের জমি সঠিকভাবে ব্যবহ্রত হচ্ছে না। ১০০ ভাগের মধ্যে মাত্র ৫২ ভাগে রয়েছে চায়ের চাষ। বাকি ৪৮ ভাগ পতিত ও চা চাষের জন্য লীজ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা, সঠিক মনিটরিং, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, কম মূল্যে সার, কীটনাশক সরবরাহ ও ক্লোনিং চা গাছ রোপণ করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।

লন্ডন ভিত্তিক একটি আর্ন্তজাতিক চা কমিটি কর্তৃক’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম স্থানে। একটানা কয়েক বছর ধরেই দশম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম। ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম। সংস্থাটির হিসাবে চা উৎপাদনে এখন শীর্ষে রয়েছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। উৎপাদনে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের নিচে রয়েছে জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো। সদ্য সমাপ্ত বছরে সারা দেশের ১৬৬টি বাগানের চা উৎপাদনের হিসাব চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। তাতে দেখা গেছে, গত বছর চা উৎপাদন হয়েছে ৮কোটি ২১লাখ কেজি। এ হিসাবে গত বছর ৪ হাজার ১০৫ কোটি কাপ চা (প্রতি ২ গ্রামে এক কাপ চা) হয়েছে দেশে। ২০১৭ সালে চা উৎপাদন হয়েছিল ৭ কোটি ৮৯ লাখ কেজি। গত বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে ৩১ লাখ কেজি বা ৪ শতাংশ। চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয় ২০১৬ সালে। সে বছর সাড়ে ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়। চা চাষের অনুকূল আবহাওয়ার জন্য ২০১৬ সাল ছিল রেকর্ড বছর। এবার (২০১৮ সাল) প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে ভাল বলে জানিয়েছেন বাগানের মালিক ও চা বোর্ডের কর্মকর্তারা। চা বোর্ডও এবার ৭ কোটি ২৩ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন ৯৭ লাখ কেজি বা ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছরের গড় উৎপাদন হিসাব করে চায়ের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা হিসাব করা হয়। ৩ বছরে গড় উৎপাদন ৮ কোটি ২০ লাখ কেজি। এর আগের ৩ বছরে (২০১৩-২০১৫) ছিল ৬ কোটি ৫৮ লাখ কেজি। চা– বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, কিছুটা প্রতিকূল আবহাওয়া বিবেচনায় নিলে এবার চা উৎপাদন খুবই ভাল হয়েছে। চা– বাগানগুলোতে এখন পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কয়েক বছর ধরে চলছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী দিনে চা উৎপাদন যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। ২০০৯ সালে চা –শিল্পের উন্নয়নে নেয়া কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চা চাষের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। সমতল ভূমিতে চা চাষ হচ্ছে। চা চাষের নতুন এলাকা উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। যেমন ২০১৭ সালে উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন হয় ৫৪ লাখ কেজি। গত বছর উৎপাদন ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ কেজি। বান্দরবানের রুমায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. মুনির আহমেদ জানান, চা চাষের আওতা ও উৎপাদন বাড়ানোর নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চা উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে। চা বোর্ড থেকে তদারকি করা হচ্ছে। সরকার এ খাতে উৎপাদন বাড়াতে যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তার কারণেই এবার কিছুটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও উৎপাদনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে।

বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা আবাদ করছেন। এমনকি পরিত্যাক্ত জমিতেও চা চাষে তাক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন পরিত্যাক্ত থাকা ভূমি চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালিতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা উৎপাদনে আশাতীত সাফল্য মিলেছে। হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ উৎপাদনের জন্য জাতীয় পদক পাওয়া হালদা ভ্যালিতে গত বছরও উৎপাদন বেড়েছে ৯ লাখ কেজি। চীনে গ্রিন টি রপ্তানির পাশাপাশি দেশে ‘ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি’ নামে ব্র্যান্ডিংও করছে পেডরোলো গ্রুপের এই কোম্পানি।

৮ বছর আগেও এ অবস্থা ছিল না চা শিল্পে। উল্টো ২০১০ সাল থেকে চা আমদানি শুরু হয়। শঙ্কা ছিল চা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। ২০১৫সালে সর্বোচ্চ ১কোটি ১৪লাখ কেজি চা আমদানি হয়। তবে এখন চাহিদার কাছাকাছি উৎপাদন হওয়ায় আমদানিও কমেছে। গত বছর চা বোর্ড ৬৫লাখ কেজি চা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুমতি দিয়েছে। অবশ্য দেশে ভোগ বাড়ায় চা রপ্তানি কমেছে। গত বছর সাড়ে ৬ লাখ কেজি চা পাকিস্থান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে।

চা ব্যবসায়ীদের সংগঠন টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও চা ব্যবসায় শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তনু বিশ্বাস জানান, উৎপাদন বাড়ায় বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। এ মৌসুমের ৩৭ টি নিলামে চায়ের গড় দাম উঠেছে কেজিপ্রতি ২৭০ টাকা। যা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। এখন দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com