দু’দেশের স্বজনদের কান্না তারপরও মুক্তি নেই মা ছেলের

ইমাদ উদ দীন॥ মুক্তি পেয়েও মুক্ত নয় মা ছেলে। হাজত বাসই এখন যেন তাদের অঘোষিত নিয়তি। সাজা শেষ হলেও নিজ দেশের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় এখনো কারাবন্দী। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বাজারিছড়া থানার খাগড়াউড়া গ্রামের অজয় বিশ্বাস (৬৫) এর স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস (৫৫) ও তার ছেলে প্রান্তুষ বিশ্বাসের (২৬) বেলায়। বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তারা এখন মৌলভীবাজার জেলা কারাগারে।
জানা যায় ভারতীয় নাগরীক জয়ন্তী বিশ্বাসের (৫৫) পাঁচ ছেলের মধ্যে একমাত্র মেয়ে রতœা বিশ্বাস। মেয়ের জন্ম ভারতে হলেও বিবাহ সুত্রে তিনি এখন বাংলাদেশের নাগরীক। রতœার শ্বশুরালয় মৌলভীবাজারের ভারতের সীমাšবর্তী জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নে। মেয়ের জামাই কিরেন্দ্র বিশ্বাস থাকেন প্রবাসে। স্কুল ও কলেজ পড়–য়া দুই ছেলে নিয়ে রতœা বিশ্বাস থাকেন জুড়ীতে। বেশ কয়েক দিন থেকে রতœা নানা কঠিন রোগে ভোগ ছিলেন। নিজের একমাত্র মেয়ের এমন অসুস্থতার খবরে তাকে একনজর দেখতে মন ছটফট করে জয়ন্তী বিশ্বাসের। তাই পাসপোর্ট আর ভিসার অপেক্ষা না করেই ছোট ছেলেকে নিয়ে ভারত থেকে সীমান্ত দালাল মারফত বাংলাদেশে আসেন। দীর্ঘদিন পর দেখা হয় মা মেয়ের। চিকিৎসার পাশাপাশি মা আর ভাইকে কাছে পেয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন রতœা। তাই চলে আসে বিদায় বেলা। ভারত থেকে আসার সময় মা ছেলের সমস্যা না হলেও যাওয়ার সময় ঘটে বিপত্তি। দালাল পরিবর্তন করায় ক্ষিপ্ত ওই দালালই অবগত করে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মা ছেলে ধরা পড়েন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ভাই,মা ও মেয়ের মায়ার বাধঁন আর নাড়ির টান কাটাতারের ভেড়া,পাসপোর্ট আর ভিসা রাষ্ট্রীয় আইনের কাছে সবই হয় অসার। তাই মেয়েকে দেখতে এসে জয়ন্তী বিশ্বাস পড়েন বিড়ম্বনায়। মা ছেলের ঠাঁই হয় বাংলাদেশের কারাগারে। এখন ওখানে কান্না থামছেনা মা ছেলের। কারাগারের বন্দী জীবনে দু’চোখের অশ্রু আর বোবা কান্নাই যেন এখন তাদের নিয়তি। তাদের এমন দূর্দশা আর অসহায়ত্বে আপ্লুত স্বজনরা। মা ছেলের এমন ভাগ্য বিড়ম্বনায় দু’চোখে অশ্রু দু’ দেশের স্বজনদের। কিন্তু তারা চেষ্ঠা করেও সুরাহ করতে পারছেন না আইনী জটিলতা।
বাংলাদেশের তরফে আইনী জটিলতার অবসান হলেও সাড়া মিলছে না ভারতের। এখন নিজ দেশে ফিরতে যেমন তারা দু’জন উদগ্রিব। তেমনি তাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন দু’দেশে থাকা পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। বাংলাদেশের স্বজনরা কারাগারে তাদেরকে দেখতে আসলে কেঁদে কেঁদে জানাচ্ছেন মুক্তির আকুতি। প্রতিত্তোরে স্বজনরা তাদের আশ্বস্ত করে শান্তনা দিয়ে নিজেদের চোখের জল সংবরণ করছেন।
জানা যায় ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বাজারিছড়া থানার লংগাইবাজার পোস্ট অফিস এলাকার খাগড়াউড়া গ্রামের মুদি দোকানী অজয় বিশ্বাস (৬৫) এর স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস (৫৫) ও তার ছেলে প্রান্তুষ বিশ্বাস (২৬) অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বাংলাদেশের পুলিশের হাতে আটক হয়ে দীর্ঘ দিন থেকে জেল হাজতে আছেন। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে কুলাউড়া থানা পুলিশের হাতে আটক হন তারা। পরে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণ করে। কন্টোল অব এন্ট্রি এ্যাক্ট ১৯৫২ এর ৪ ধারা অনুযায়ী মৌলভীবাজার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজেস্ট্যাট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজেস্ট্যাট হাবিবুর রহমানের (৫নং আমলী) আদালতে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবান বন্দির পর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২০১৬ সালের ১০ই এপ্রিল ১মাসের বিনা শ্রম কারাদন্ড এবং ১ হাজার টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে ১০ দিন বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু আদালতের দেওয়া সাজা প্রায় ১১ মাস আগেই শেষ হলেও তাদের নিজ দেশের (ভারতের) সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে এখনো তারা কারা বন্দী। আর নিজ দেশে ফেরা নিয়েও তারা রয়েছেন উদ্বিঘœ।
তাদের স্বজনরা জানান তারা নানা ভাবে ভারতের সীমান্তরক্ষী,হাইকমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু তাদের তরফে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে বিলম্ব হওয়ায় বাংলাদেশের আদালতের দেওয়া সাজা শেষ হওয়ার দীর্ঘদিন পরও মুক্তি পেয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারছেন না তারা। আর তারা মুক্তি না পাওয়াতে তাদের চিন্তায় ভারত ও বাংলাদেশে থাকা তাদের স্বজনরা রয়েছেন চরম হতাশায়।
জানা যায় মৌলভীবাজার চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাট্রিজের উদ্দ্যোগে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গেল বছরের ২৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী ভারত বাংলাদেশ মৈত্রি উৎসব ও ব্যবসায়ী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য পর্বে বিষয়টি উঠে আসে। সাজা শেষ হওয়ার পরও ভারতীয় নাগরীক মা ছেলের হাজত বাসের মানবিক বিষয়টি নিয়ে মৌলভীবাজার সদর পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান উপস্থিত দু’দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণ করে বক্তব্য দেন। এই মানবিক মর্মস্পর্শী বিষয়টি সম্পের্কে অবগত হন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাণিজ্য,শিক্ষা ও আইন মন্ত্রী শ্রী তপন চক্রবর্তীসহ ভারত ও বাংলাদেশের সাংবাদিক,শিল্পী,কবি-সাহিত্যিক,ব্যবসায়ী,রাজনীতিবীদ ও দু দেশের সরকারের জেলা ও বিভাগ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বক্তব্যে এই বিষয়টি ইঙ্গিত করেই বলেন ভারতের নাগরীকদের বিনা কারণে একটি মুর্হুত আমরা আটক রাখতে চাইনা এবিষয়ে আমারা যথেষ্ট আন্তরিক।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া দু’দেশের সাংবাদিকরা ঘটনাটির আদ্যোপ্রান্ত জানার চেষ্ঠা করেন। খোঁজ নিয়ে কারাগারে আটক মা ও ছেলের দু’দেশে থাকা তাদের স্বজনদের সন্ধানও পান। আর তাদের স্বজনদের মাধ্যমেই বিস্তারিত জানা হয় এই হ্রদয় বিদারক ঘটনাটির। জানা যায় মৌলভীবাজার জেলা কারাগারে এই মা ও ছেলে ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে সাজা শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন থেকে আরো ৪ জন ভারতীয় নাগরীক বন্ধী রয়েছেন। এই ৪ বন্ধী হলেন সনজিদ কুমার ত্রিপুরা (৩৪),পিতা সুবল ত্রিপুরা,গ্রাম,পোস্ট অফিস ও জেলা খোয়াই,ভারত। রিটং ত্রিপুরা রিটুম(৩২),পিতা রেনু ত্রিপুরা,গ্রাম রাজনগর,পোস্ট অফিস ও জেলা খোয়াই ভারত। নয়ন দেব বর্মণ(৩৩),পিতা লেচি দেব বর্মণ,গ্রাম,পোস্ট অফিস ও জেলা আগরতলা ভারত। নিলু সিং (৪৪) পিতা মেরা সিং,গ্রাম থৌবাল,জেলা মনিপুর ভারত।
ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাদের দেশে ফিরেয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে বিলম্ব করাসহ অকেটা উদাসীনতায় তারা এখনো বন্ধী রয়েছেন এমনটিই দাবী তাদের স্বজনদের।
এ বিষয়ে ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক উত্তর ত্রিপুরার সম্পাদক মুহিত পালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক মা ও ছেলে তারা কোন দাগী অপরাধী নয় অথচ সাজা শেষ হওয়ার দীর্ঘদিন পরও তারা জেল হাজতে রয়েছেন। আমি ভারতে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করেছি।এই ঘটনার পর থেকে তারা সকলেই মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। এই মানবিক বিষয়টি নিয়ে আমরা ভারতের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগযোগ করছি। যতটুকু জেনেছি বাংলাদেশের তরফে তারা মুক্তি পেতে এখন আর আইনী কোন বাধা নেই এবং তারা এই মানবিক বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আন্তরিক।
মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএম উমেদ আলী বলেন এই বিষয়টি অবগত হওয়ার পর মানবিক কারণে আমরা এ দেশে থাকা তাদের স্বজনদের খোঁজে তাদেরকে সহযোগীতা করতে আগ্রহী হই।যে হেতু দু’দেশের রাষ্ট্রীয় আইনী বিষয় তাই সংশ্লিষ্টরা আরও আন্তরিক ভাবে এই বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা করছি।
মন্তব্য করুন