বিএসএফের গুলি! স্বর্ণা বললো মা হাতটা ছেড়ে দাও, আমি আর বাঁচবো না

এস এম উমেদ আলী॥ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের নির্মমতার বলি স্বর্ণার পরিবার অজনা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। মুখ খুলে কারো সাথে কথা বলছেননা। থামছে না তাদের পরিবারে কান্না। বাবা পরেন্দ্র দাস ও মা সঞ্জিতা রানী দাস বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পরিবারের কনিষ্ট সদস্যকে হারিয়ে তারা এখন নির্বাক। একই অবস্থা প্রতিশেীর মধ্যে। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে স্বর্ণা ছিল ছোট। স্বর্ণা পরপারে পাড়ি দেয়ায় তার সহপাঠিরা তাকে না পেয়ে তারা বিচলিত। জুড়ী উপজেলার স্থানীয় নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেধাবী স্বর্ণা পুরো স্কুল মাতিয়ে রাখতো। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার কালনীগড় গ্রামে এখন সুনসান নিরবতা চলছে। চলছে এই জনপদ শোকের মাতম।
স্বর্ণা মায়ের সঙ্গে গত পহেলাা সেপ্টেম্বর রোববার রাত অনুমান ৯টার দিকে কুলাউড়ার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারত যেতে চেয়েছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর এলাকার শনিচড়া গ্রামে তার মামার বাড়ি। স্বর্ণার এক ভাই মামা কার্তিক দাসের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে আছেন। আপন ভাইকে দেখা ও মামার বাড়ি বেড়ানোর উদ্যেশে স্বর্ণা ও তার মা সীমান্তে যান।
স্বর্ণা দাসের বাবা পরেন্দ্র দাস বলেন, রোববার সকালে মা ও মেয়ে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। সোমবার সকালে স্বর্ণার মামার বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারি তারা যায়নি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক সেনা কর্মকর্তার সহযোগিতায় শমশেরনগর থেকে স্বর্ণার মাকে উদ্ধার করি। পরদিন সোমবার বিকালে ৪৬ বিজিবি সীমান্ত ক্যাম্প কমান্ডার মাধ্যমে আমার মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই। ভারতের ত্রিপুরায় তার বড়ছেলে থাকেন। তাকে দেখতে স্বর্ণা ও তার মা রোববার রাতে দালালের সহযোগিতায় লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রাত ৯টার দিকে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছালে বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালালে স্বর্ণা ঘটনাস্থলে মারা যায়। ভাগ্যক্রমে স্বর্ণার মা বেঁচে যান।
কুলাউড়া উপজেলার শরিফপুর ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান জানান, মোট ৪ জন বাংলাদেশী দালাল মাধ্যমে সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে গেলে বিএসএফ গুলি করলে ঘটনাস্থলে এক কিশোর নিহত হয়। এঘটনায় অরোও ২ জন আহত হয়। আহতদের সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাদের বাড়ি চট্রগামে।
স্বর্ণার ভাই পিন্টু দাস তার মায়ের মুখ থেকে শুনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, হঠাৎ বিএসএফকে স্বর্ণা কাটাতারের পাশে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলে ‘আমাদের মেরো না আইনের আশ্রয়ে নিয়ে যান’। কোন কথা না শুনে বিএসএফ যখন একেবারে কাছে থেকে বন্দুক তাক করে, তখন স্বর্ণা দেখে ঘুরে যায়। তখন পেছন দিকে বিএসএফ গুলি করলে গুলি ঢুকে বুকের ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখনই স্বর্ণা বলে, মা হাতটা ছেড়ে দাও, আমি আর বাঁচবো না। তোমার প্রাণ রক্ষা করো।
পিন্টু দাস আরও জানান, ওই সময় চট্টগ্রামের একটি পরিবারের সঙ্গে আমার মা ও বোনকে দালালরা ভারতে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করে। নির্দয় বিএসএফের গুলিতে আমার বোনের শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে।
বিএসএফএর গুলিতে নিহত স্বর্ণা দাস ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল। সব বড় ভাই বলরাম দাস ভারতে মামার সাথে থাকেন, মেঝ ভাই রিংকু দাস থাকেন ওমানে, তৃতীয় ভাই পিন্টু দাস বাড়িতে থাকেন ও এক বোন প্রনীতা রানী দাস পার্শবর্তী এলাকায় স্বামীর সাথে বসবাস করছেন।
পশ্চিম জুড়ী ইউপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি বড় নম্র ভদ্র ছিল। পুরো গ্রামেই তার সুনাম ছিল। গুলি করে মারার অধিকার কে দিলো বিএসএফকে। আমরা সীমান্তে গুলি করে মারাকে সমর্থন করি না। আর কতো ফেলানির মতো লাশ সীমান্তে পড়বে।
স্বর্ণার স্কুল সহপাঠী মারিয়া জান্নাত, হুমাইরা আক্তার ও ইসরাত জাহান নুরা জানায়, পড়ালেখায় সে ভালো ছিল। খেলাধুলাও আমাদের সাথে করতো। সুন্দর কথাবার্তায় পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখতো। বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে ভাবতে কষ্ট হয়। এই বাহিনী এত নির্মম কেন। ওদের কি স্বর্ণার মতো কোন সন্তান নেই। আমরা স্বর্ণ হত্যার বিচার চাই।
স্বর্ণা যে স্কুলে লেখাপাড়া করতো, সে স্কুলের শিক্ষক তপনকান্তি দাস জানান, সে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল সে মেধাবী। সে ছিল বহুমুখি প্রতিবার অধিকারী। তার সহপাঠী, শিক্ষকসহ এলাকাবাসি এ মৃত্যু কোন ভাবে মেনে নিতে পরছেননা। তিনি এ হত্যাকান্ডের সুষ্ট বিচারের দাবীসহ সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের জোরদাবী করেন।
পতাকা বৈঠক শেষে প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে স্বর্ণা দাসের লাশ হস্তান্তর করে বিএসএফ। এর আগে বিএসএফ বিকেল ৫টার দিকে লাশ সীমান্তে নিয়ে আসে।
মন্তব্য করুন