হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষীদের তারপরও প্রাণপণ প্রচেষ্ঠা পচা ধান সংগ্রহের

May 9, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ কোন কাজ নেই।ঘরেও মন বসে না। তাই পচা ধান কাটতে আইছি। যা পাব তাতেই সন্তুষ্ট। হাওরের তীরবর্তী অংশের ডুবে থাকা আধপাকা পচা ধানেই এখন এমন স্বপ্ন চাষীদের। জেলার হাকালুকি,কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওরের সর্বস্বান্ত কৃষক এখন পচা ধান সংগ্রহে ব্যস্ত।এবছর হঠাৎ চৈত্রের আগাম বন্যায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া থোড়দেওয়াা বোরো ধান একেবারেই নষ্ট হলেও কিছুটা ধান মিলছে আধপাকা অবস্থায় ডুবে যাওয়া বোরো ধান গাছ থেকে। গেল ক’দিন থেকে পানি কমেছে হাওরের তীরবর্তী কিছু এলাকায়।এতে অগ্রভাগ ভেসে উঠেছে মরা পচা বোরো ধানের। এমন অবস্থায় হাওর পাড়ের সর্বস্বান্ত কর্মহীন চাষী ঘরে বসে অলস সময় কাটাতে চান না। তাই নেশার টানে এখন তারা ছুটছেন ওই ধান সংগ্রহ করতে। কর্মচঞ্চল কৃষকরা নৌকা যোগে বুক পানি কিংবা কোমর পানি থেকে সংগ্রহ করছেন ধান। সারা দিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে আনা ধান মাড়াই ও অনান্য প্রক্রিয়া শেষে প্রাপ্ত ধান দেখে শুধুই দু’চোখের জল ফেলছেন। নৌকায় বোজাই করা সংগৃহিত ধানে সবপ্রক্রিয়া শেষে হচ্ছে ৮ কিংবা ১০ কেজি। যে খানে বন্যায় ক্ষতি না হলে মিলত ১২০-১৩০ কেজি ধান। তারপরও ঘরে না বসে ডুবে থাকা পচে যাওয়া বোরো ধান সংগ্রহে ব্যস্ত হাওর তীরের কয়েকটি এলাকার চাষীরা। মনসান্তনা এমন করে যদি কিছু ধানও ঘরে তুলতে পারেন তাহলে ‘ঊনা উপাস’ (খালি পেটে) থাকার ছেয়ে দু’মুঠো ভাত পরিবার পরিজনের মুখে দিতে পারবেন। জানালেন দূর্দিনে পড়ে তারা এমনটিই টের পাচ্ছেন। ব্যাক্তি থেকে সরকার সকলেই শোনান শুধু আশার ফুলঝুরি। কিন্তু উদার মনে প্রকৃত অর্থে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেন না। যারাই আসেন অধিকাংশ লোক দেখানো জনদরদী সেজে নিজেদের ফাঁয়দা লুটতে। গেল প্রায় মাস দিন থেকে এমনটিই আচঁ করেছেন তারা।

এবারে চৈত্রের আগাম বন্যায় সবহারিয়ে দিশেহারা কৃষক ভেসে উঠা মরা পচা বোরো ধান দেখে আহাজারি করছেন। শেষ বারের মত চাষীদের প্রাণপণ প্রচেষ্ঠা ওই পচা ধান গাছ থেকেও যদি কিছু ধান সংগ্রহ করতে পারেন। এমন স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় এখন কাস্তে হাতে নৌকা যোগে হাওরেই সময় কাটাচ্ছেন অনেক বোরো চাষী। কিন্তু সারাদিন শক্ত খাটুনির পর যে ধান পাচ্ছেন সেটা মন বুঝানোর মত নয়। তারপরও প্রতিদিন কাস্তে হাতে নৌকা নিয়ে ছুটছেন হাওরে। স্বপ্নের বোরো ফসলের নেশায় তাদের টেনে নিচ্ছে হাওরে।পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পচে ধান গাছে যেমন র্দূগন্ধ। তেমনি ধানেও। কৃষকরা জানালেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ সুত্রে তারা জেনেছেন ওই পচা বোরো ধান সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে বা সেদ্ধ করে শুকিয়ে ওই চাল থেকে ভাত খেলে কোন সমস্যা হবে না। বা ওই চালের গুনগত মানও নষ্ট হবে না।এরপর থেকে হাওরের তীরবর্তী অংশের যে আধপাকা ধান বানের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল তা কিছুটা ভেসে উঠায় এখন তা সংগ্রহ করছেন চাষীরা। এশিয়ার বৃহত্তম  হাকালুকি হাওর ও কাউয়াদিঘি আর হাইলহাওরে অকাল বন্যার এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওরের শতভাগ বোরো ধান। একমাস পরও যদি কিছু ধান পাওয়া যায় এই আশায় পচা ধান সংগ্রহে প্রাণপণ প্রচেষ্ঠা চলছে হাওর তীরের কৃষকের। গতকাল সরজমিনে হাকালুকি হাওরের বড়লেখা,জুড়ী ও কুলাউড়া অংশে এমন দৃশ্য দেখা গেল। হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া ভুকশিমইল ইউনিয়নের মদনগরীর বশির উদ্দিন(৫০),কুরবান পুরের আব্দুল মন্নান (৬৫),উত্তর সাদিপুরের জালাল মিয়া (৪৬), বারিক মিয়া

(৬৮),ফারুক মিয়া (৬৪),আতির আলী (৬৬) জানালেন আধপাকা অবস্থায় যে ধান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল তা কিছুটা ভেসে উঠায় এখন তা সংগ্রহ করছেন তারা। কিন্তু সারা দিন পরিশ্রম করে যে ধান পান তা দিয়ে মন ভরে না। তারপরও যদি কিছু ধান সংগৃহিত হয় এমন আশায় তারা এখন পচা ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। জুড়ীর জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়া (৩৮),মানিক মিয়া (৪৫),দলা মিয়া (৫০), রুমি বেগম (২৪),সুলতানা বেগম (৪০), বানেছা বেগম (৪৮) জানান তলিয়ে যাওয়া ধান জেগে ওঠায় আশা ছিল কিছু যদি পাই। নিজে এবং মানুষ দিয়ে পেড়া (পচা) ধান দাওয়াইয়া (কাটিয়ে) তুলছিলাম (তুলেছি)। কিন্তু শতকরা দশটা ধানও ভালো নেই। তাদের মত অনেকেই রাস্তার উপর ধান মাড়াই ও পরিষ্কার করতে করতে বললেন ধান নেই  কি খাব সারা বছর ? ছেলে সন্তান নিয়ে কি উপুস থাকব। কেঁদে কেঁদে তাদের এমন দু:শ্চিন্তার কথা বলেন। চাষীরা জানান,নৌকা দিয়ে পানির নীচ থেকে ধান তুলে এনে প্রথমে রোদে শুকান। তারপর মাড়াই দিয়ে ঝেড়ে যদি কিছু ধান পাওয়া যায় এই আশায় তারা এখন প্রতিদিনই পরিশ্রম করছেন। কিন্তু আশানুরুপ ধান পাচ্ছেন না। শাহপুর গ্রামের প্রজ্বলল বিশ্বাস (৫২), মুহিন আহমদ (১৯),সেলিম আহমদ (২৫),শফিক আহমদ (৫০) বলেন চৈত্রের অকাল বন্যায়  হাওরের ধান যেমন গেছে তেমনি মাছও। মরেছে পোষা হাঁস,জলজ প্রাণী ও গবাদি পশুও। এমন দূর্যোগ এর আগে তারাসহ এই অঞ্চলের মানুষ কখনো দেখেনি। এত সম্পদের হাওরে এখন কিছুই নেই। এই হাওরকে ঘীরেই তাদের জীবন জীবীকা। কিন্তু এবছর হাওরই যে শূন্য। তাই তারা খাওয়া বাঁচা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কাউয়াদিঘি হাওর তীরের কাশিমপুর পাম্প হাউজ এলাকায় রাস্তার পাশে পানি থেকে তুলে আনা পচা বোরো ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত কৃষক আমির মিয়া (৫৩),সাহিব মিয়া (৪৮),সুনিল মালাকার (৪৫), প্রবাস মালাকার(৫২) জরিনা বেগম (৪৬), সুজিনা বিবি (৫০), নূরী বেগম (৩৬) সহ অনেকেই জানালেন এবছর বীজ রাখার মত কোন ধান রাখেনি আগাম বন্যায়। অন্য হাওরের মত তাদের এমন দূর্ভাগ্য হওয়ার কথা ছিলনা। কিন্তু নানা অজুহাতে এখানকার পাম্প হাউজের সবকটি সেচ মেশিন চালু না রাখায় এমন র্দূদশা তাদের। এখন পানির নীচে থাকা ধান কিছুটা ভেসে উঠায় তা সংগ্রহের জন্য প্রাণপণ চেষ্ঠা চালাচ্ছেন। কিন্তু যা পাচ্ছেন তা দিয়ে তাদের পারিশ্রমিকও হচ্ছেনা।একই অবস্থা হাইল হাওরের তীরবর্তী দু’একটি এলাকায়ও। চাষীরা চেষ্ঠা করছেন কিছুটা হলেও যদি পচা ধান গাছ থেকে ধান পাওয়া যায়। কিন্তু কেউই আশানুরুপ ধানই পাচ্ছেন না বলে জানালেন। কারণ ধান পুক্ত হওয়ার আগেই পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় এমন বেহাল দশা। তবে জেলার ওই ৩টি হাওরসহ অনান্য হাওর ও নদী এলাকার বোরো ধান হারানো চাষীরা অভিযোগ করে বলেন তাদের এলাকার অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারী তরফে আসা সাহায্য সহযোগীতা এখনো পাননি।তাদের জোর দাবী তাদের এমন দূর্দিনে সরকারের পাশাপাশি বৃত্তশালীরাও যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: শাহজান বলেন পচা ধান গাছ থেকে সংগৃহিত বোরো ধান শুকিয়ে খাবার উপযোগি করে খেলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেন না ধান পচেছে প্রাকৃতিক নিয়মে। মুলত ধান গাছ পচে গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই ওই ধান নিয়ে আশঙ্কার কোন কারণ নেই।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com