হাকালুকির ক্ষতি ধান ও মৎস্য সম্পদের : পানির স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে

April 22, 2017,

এস এম উমেদ আলী॥ হাকালুকি হাওরের পানিতে তলিয়ে থাকা ধান পচে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস এর মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। আধা কাঁচা ধান পঁচে গত কয়েকদিনে হাওরে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে মাছ, হাঁস ও জলজ প্রাণী মারা যায়। অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে মারা যাওয়া পচা মাছ আর পচা ধানের দুর্গন্ধ ঝড়ো হাওয়ায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পানিতে অ্যাসিড ও ক্ষার এর মাত্রা ৮ দশমিক ৫-এর বেশি হলে পানির স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যে কোন ধরনের জলজ মারা যায় বলে মৎস্য বিশেষঅজ্ঞরা জানান। দু’দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া অনুকুলে আসায় ও মৎস্য বিভাগ হাওরের পানিতে চুন ও ঔষধ ছিটালে পানির স্বাভাবিকতা ফিরে আসে।
হাওরের এ পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সৈয়দ মেহেদি হাসানের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সমন্বিত দল এবং স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে হাকালুকি হাওর যান। মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকার্তা আ ক ম শফিক-উজ-জামান শুক্রবার সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেন।


মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সৈয়দ মেহেদি হাসান দিনভর এলাকার মৎস্যজীবী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। এসময় তার সঙ্গে সমন্বিত দলের সদস্য হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন মৎস্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ রমজান আলী, মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকার্তা আ ক ম শফিক-উজ-জামান, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ খান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ সহ মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পরিদর্শন শেষে দলটির পক্ষ থেকে আরও জানান, সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং পানি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে হাওরের অবস্থা প্রায় স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান জেলার জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলায় লক্ষ টাকার চুন ছিটানো হয়েছে। বিষক্রিয়ায় মারা যাওয়া ও অসুস্থ মাছ খেলে বিভিন্ন কঠিন রোগের আশংকা রয়েছে। এজন্য এক সপ্তাহ মাইকিং করে মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর শুক্রবার থেকে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যার করা হয়েছে।
সরেজমিন হাকালুকি হাওরের চকিয়া বিলে গেলে দক্ষিণ হাকালুকি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির লোকজন জানান, চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় ২৫ সহস্রাধিক হেক্টর জমির বোরো ধানের পাশাপাশি হাকালুকি হাওরের ছোটবড় ২৩৭টি বিলও তলিয়ে যায়। জলমহালগুলো নির্দিষ্ট সময়ের আগে হাওরময় ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে অকাল বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে। এতে পানি দুষিত হয়ে ব্যাপকহারে মাছে মড়ক লেগেছে। হাওরের চকিয়া বিলে ৩ বছরের জন্য ইজারা নেয়ায় ইজারাদার সেখানে ১৫ লাখ টাকার পোনা মাছ অবমুক্ত করেন। কিন্তু মাছের মড়কে সেই তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবেন বলে জানান। এব্যাপারে সমিতির পক্ষ থেকে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করা হয়।
হাকালুকি হাওর তীরের ভাটেরা ইউনিয়নের কবির আহমদ, নোমন আহমদসহ বেড়কুড়ি, দক্ষিণভাগ গ্রামের মানুষ জানান, হাওর থেকে যখন বাতাস আসে তখন দুর্গন্ধে যেন নাড়ি ভূড়ি ছিড়ে বমি আসে। মাছ আর ধান পচে একাকার। দুর্গন্ধে এলাকায় বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।


সরেজমিন পরিদর্শণকালে হাকালুকি হাওরে প্রচুর মরা মাছ ভেসে থাকতে দেখা যায়। ভেসে উঠা মরা মাছের মধ্যে ছিলো পুটি, টেংরা, ভেদা, বাইলা, বোয়াল মাছ, বোয়াল মাছের পোনা, চান্দা, পাবদা এবং রুই জাতীয় মাছের ছোট পোনা মরে ভেসে উঠছে। তলিয়ে যাওয়া ধান ও পচা মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে হাওর জুড়ে। হাওর তীরের ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এখানে ২-৪ বছরের ব্যবধানে পাহাড়ী ঢলে অকাল বন্যা হয়। কিন্তু এবারের মত চৈত্র মাসে কখনও বন্যা হয়নি। এই অকাল বন্যায় ধানের পচনে মাছেও মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজন্ন কেন্দ্রটিতে মৎস্য প্রজনন হুমকির মুখে পড়বে। সংকট সৃষ্টি হবে মাছেও। এমনিতে নেই ধান আর সেই সাথে যদি মাছও না থাকে তাহলে হাওর তীরের মানুষের জীবন জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
হাকালুকি পাড়ের বাসিন্দা কৃষক আবুল হোসেন, মলিক মিয়া ও সবু মিয়ারা বলেন, পানিতে ধান নিয়েছে। অভাবের সংসার হাঁসের ডিম বিক্রি করে চালাতেন। হাঁস মরে যাওয়ায় একটি এনজিও থেকে তোলা ঋণ কিভাবে শোধ করবেন এ নিয়ে চিন্তিত তারা। হাকালুকি হাওর পাড়ের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার আশিঘর গ্রামের মাইজভাগ এলাকার বাসিন্দা কাদিম শাহ বলেন, খামারিরা হাওরে হাঁস ছাড়লে মাছ ও পোকা খেয়ে একের পর এক হাঁস মারা যায়।
অপর দিকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, চলতি বছরে জেলায় রোরো ধানের আবাদ হয়েছিল ৫৩ হাজার ৪শত ৬০ হেক্টর জমিতে। ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়ে ১০ হাজার ২‘শ ৭৬ হেক্টর জমির ধান একেবারে নষ্ট হয়ে ৩৫ হাজার ৫‘শ ১৮ মেট্রিক টন চাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যা টাকার অংকে ১‘শ ১৩ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা। আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ৩০হাজার ৮‘শ ৩০ জন কৃষক । ঢলের পানিতে হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, কাউয়াদিঘীর হাওর, বড় হাওর, করাইয়ার হাওর ও কেওলার হাওরের ধান তলিয়ে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হাকালুকি হাওরে।
বোরো ধান এবং মাছ হারাতে বসে হাওর এলাকার কৃষকরা যে বিপাকে পড়েছে, তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আগামী ১ বছরের রেশনিং ব্যবস্থা চালু সহ ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতার দাবী উঠেছে। এ ছাড়াও হঠাৎ করে একের পর এক দূর্যোগে দিশেহারা হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎজীবীদের রক্ষায় হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রনে স্থায়ী বেরীবাঁধ নির্মানের দাবী করছেন ক্ষতিগ্রস্থরা।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com