হুমকিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মৌলভীবাজারে থামছেনা পাহাড় কাটা

ইমাদ উদ দীন॥ প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে মাটি কেটে সাবাড় হচ্ছে টিলা। বিক্রি হচ্ছে মাটি। ন্যাড়া হচ্ছে পাহাড়। উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। আবাসন ও খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যপ্রাণী। আর মহাহুমকিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। কিন্তু তারপরও কিছুতেই থামছেনা পাহাড় খেকো চক্র। এখন জেলা জুড়ে দিন দুপুরেই দেদারছে চলছে পাহাড় কাটা। বে পরোয়া পাহাড় খেকোচক্র। এমন অপকর্ম থামাতে তৎপর নয় সংশ্লিষ্টরা। দায়সার গুচরের দু’একটি অভিযানেই দ্বায়িত্ব পালন শেষ। এমন উদাসীনতায় ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পাহাড়ী টিলা, প্রকৃতি ও বনজ পরিবেশ। এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। এখন প্রতিনিয়তই এমন দৃশ্যই চোখে পড়ছে পাহাড়ী এলাকা গুলোতে। প্রভাবশালী চক্রের এমন বেপরোয়া মনোভাবে বরং দিন দিন এ ধ্বংষযজ্ঞ বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ পাহাড় কেটে পাদদেশে বসতঘর বানাচ্ছেন। অনেকেই মাটি বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ তৈরী করছেন রিসোর্ট বা বাগান। রাস্তা তৈরী বা মেরামতের অজুহাতসহ নানা ছুতায় কায়দা কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়। কিছুতেই থামছেনা পাহাড় কাটা। রহস্যজনক কারনে নির্বিকার স্থানীয় প্রশাসন। এ কারনে দিন দিন ছোট হচ্ছে এ জেলার পাহাড় ও বনাঞ্চলের আয়তন। একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে চালাচ্ছেন এই নিধনযজ্ঞ। পাহাড় কাটার এমন উৎসবে এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রভাবশালীদের খপ্পরে অস্তিত্ব সংকটে এ জেলার পাহাড়ী টিলা ও বনজ সম্পদ। জেলার কয়েকটি উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় এখন হরদম চলছে এমন বে-আইনী কর্মযজ্ঞ। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এলেই নির্বিচারে চলে পাহাড় কাটা। আর বর্ষা মৌসুমে ঘটে পাহাড় ধ্বংসের ঘটনা। তখন পুরো বর্ষা মৌসুম জুড়ে থাকে প্রাণহানি ও সম্পদ হানির চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা। এনিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হতাহতের ঘটনা এড়াতে তখন স্থানীয় প্রশাসন হন তটস্ত। কিন্তু এখন অবাধে পাহাড় কাটা বন্ধে কোন শক্ত প্রতিকার না নিয়ে বরং তারা অনেকটাই নীরব দর্শক। এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে কোন কোন উপজেলায় মাঝে মধ্যে প্রশাসন উদ্যোগী হন। চালান অভিযান। এতে কিছু দিনের জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হয়। অভিযান অব্যাহত না থাকায় কিছু দিন পর আবারো যেই সেই। স্থানীয়দের অভিযোগ কোথাও প্রশাসনকে লুকিয়ে। আবার অনেক স্থানে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলে এই বে-আইনী কর্মযজ্ঞ। এলাকাবাসী জানান ওই চক্র প্রথমে গাছ ও বনাঞ্চল উজাড় করে। তারপর সুযোগ বুঝে ওই ন্যাড়া পাহাড়ী টিলার মাটি কাটতে শুরু করে। সরজমিনে ওই সকল এলাকায় গেলে চোখে পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবাধে পাহাড় কেটে তা গাড়ি দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য। কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা,ভাটেরা ও বরমচালে কমবেশি পাহাড়ী টিলা কাটা হলেও দেদারছে দিন দুপুরে পাহাড় কাটা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম জালালাবাদ (সাতনম্বর) এলাকায়। সম্প্রতি একটি অভিযান হলে কয়েক দিন বন্ধ থাকার পরও আবার কাটা হচ্ছে পাহাড়। ওই এলাকার পাশ্ববর্তী গ্রামের সড়ক দিয়ে এসকল পাহাড়ী মাটি পরিবহন করাতে অতিরিক্ত চাপে তা ভেঙ্গে যাচ্ছে। জানা যায় বড়লেখা উপজেলার পাহাড় ঘেষা কাঁঠালতলী, বিওসি কেছরিগুল, ডিমাই, শাহবাজপুর, সায়পুর, কলাজুরা, হাকাইতি,কাশেম নগর, জামকান্দি, মোহাম্মদ নগর,সাতরা কান্দি, গঙ্গারজল,জফরপুর,কাশেমনগর,গজভাগ,পূর্ব হাতলিয়া,বোবারথল,মোহাম্মদনগর,ছোট লেখা, ঘোলসা, চন্ডিনগর, মুড়াউল, আতুয়া, বড়াইল, কুমারশাইল, পূর্ব বানীকোনা, শ্রীধরপুর,মাধবকুন্ড, খলাগাও, মুড়াউলসহ অনেক এলাকায় আগে কাটা হয়েছে কিংবা এখন প্রকাশ্যে দিবালোকে কম বেশি কাটা হচ্ছে পাহাড়ী টিলা। এসকল এলাকার কোন কোন স্থানে এখন কিছুটা থামলেও বেশির ভাগ স্থানে গোপনে ও প্রকাশ্যে অবাধে চলছে পাহাড় কাটা। এমনটিই অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের। জুড়ী উপজেলার উত্তর ভবানীপুর (মোকাম টিলা), ভজি টিলা,চম্বকলতা,বড় ধামাই,কচুরগুল,জামকান্দি,গোবিন্দপুর,জায়ফর নগর, গোয়াল বাড়ি,পশ্চিম জুড়ী ও পূর্ব জুড়ী ইনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় কমবেশি কাটা হচ্ছে পাহাড়। রাজনগরের উত্তরভাগ ইউনিয়নের যুদুরগুল এলাকার খাসের টিলা কেটে ভরাট হয়েছে শাহজালাল সারকারখানার আবাসিক এলাকার জমি। বিশাল বিশাল টিলা কেটে তখন মাটি নেয়া হয় কারখানার ‘কলাবাগান’ আবাসিক এলাকায়। নির্বিচারে পাহাড় কাটার বিষয়ে তখন গণমাধ্যম সোচ্চার হলে প্রসাশনের তৎপরতায় মাস দিন তা বন্ধ থাকে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই ওই উপজেলার বিভিন্ন ছোট বড় পাহাড়ী টিলার মাটি কাটা। পাহাড় কাটার অভিযোগ কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার সদরেও। শ্রীমঙ্গলে পাহাড়ী টিলা কেটে তৈরী হচ্ছে রির্সোট, হোটেল ও ফলজ বাগান । জানা গেল জেলা জুড়ে পাহাড় খেকো চক্র শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রয় করে। আর বর্ষা মৌসুমে পাদদেশে তৈরী করে বসতঘর। পাহাড় কাটা ও বসতঘর তৈরীর নেপথ্যে থাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। তাই স্থানীয় প্রসাশন দেখেও না দেখার ভান করে। পরিবার পরিজন নিয়ে মাথা গুজাবার বিকল্প জায়গা নেই। তাই ওদের ছত্রছাঁয়ায় ভূমিহীন মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ঠাঁই নেন। দীর্ঘ প্রায় ৩ যুগেরও বেশী সময় ধরে চলছে এমন বে-আইনী কাজ। কিন্তু কিছুতেই তা থামছেনা। জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এই ৩টি উপজেলার পাহাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা গেল এমন দৃশ্য। এই ৩ উপজেলার স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পাহাড়ের চূড়া আর পাদদেশে এরকম ঝুঁকিপূর্ন স্থানে বসবাসকারীদের সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষাধীক। স্থানীয় সুত্রে জানা যায় বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় ইতিপুর্বে মাটি কাটতে গিয়ে অন্তত ১২-১৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর ভারি বর্ষণে টিলার মাটি ধসে মা মেয়েসহ গত ৫ বছরে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া পাহাড়-টিলা ধসে শিশুসহ অসংখ্য ব্যাক্তি আহতও হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপার) মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ.স.ম ছালেহ সুহেল বলেন অব্যাহত টিলা কাটার ফলে এজেলার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এ অঞ্চলের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর এরই সাথে বদলে যাচ্ছে ভূ-মানচিত্রও। এজেলার প্রকৃতি বাচাঁতে ওই চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী পদক্ষেপ নিতে তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবি জানান।
মন্তব্য করুন