১৫ বছর ধরে শ্রীমঙ্গলে সার সিন্ডিকেট: একই পরিবারের একাধিক ডিলারশীপের অভিযোগ

October 17, 2024,

এহসান বিন মুজাহির  : শ্রীমঙ্গলে ১৫ বছর ধরে বিসিআইসি সারের ডিলারদের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং ডিএপি সারের ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের মাধ্যমে একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তির নামে ডিলারশীপ প্রদান, সার ডিলার নিয়োগ নীতিমালা-২০০৯ উপক্ষো করে অনিয়মের মাধ্যমে বিসিআইসি ডিলার নিয়োগ, অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতাদের সময় ও প্রয়োজনমতো সার প্রদান না করা এবং অতিরিক্ত মূল্যে সার বিক্রির ঘটনাটি সামনে এসেছে।

দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে শ্রীমঙ্গলে ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় বিসিআইসির সারের ডিলার নিয়োগ দেয় সরকার। এছাড়া সে সময়ে এসব এলাকার প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধার্থে আরো ৬৪ জন খুচরা সার বিক্রেতাও নিয়োগ করা হয়।

তৎকালীন সময়ে ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় সারের ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও হয়েছিল বিশাল ঘাপলা। যারা ডিলার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে পাঁচ জনের বাড়ি ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নে, এক জনের বাড়ি ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নে, এক জনের বাড়ি ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নে, এক জনের বাড়ি ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নে এবং এক জনের বাড়ি ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নে।

অভিযোগ রয়েছে, যে দশ জন সারের ডিলারশীপ নিয়োগ পেয়েছেন তাদের ছাড়া নিয়োগকালীন সময়ে আর কাউকে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন তারা তৎকালীন সময়ের সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরীক জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থক। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। একই পরিবারের সদস্যরা একাধিক ডিলারশীপ নিয়ে সারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

ওই দশ ডিলারের মধ্যে আবার একই পরিবারের একাধিক ডিলারও রয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের ডিলার অনুকুল চন্দ্র দাশের ভাই পরিমল দাশ ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নের ডিলার। এছাড়া, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের ডিলার স্বপন কপালী ও ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়নের ডিলার শান্ত কপালীও আত্মীয়। ফলে, সারের বাজারে প্রতিযোগিতা হ্রাস পেয়ে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে যারা বিসিআইসি সারের ডিলারশীপ পেয়েছিলেন তারা হলেন শ্রীমঙ্গল পৌরসভা এলাকার জন্য মোমিনুল হোসেন সোহেলের মালিকানাধীন সোহেল এন্টারপ্রাইজ, ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়ন এলাকার জন্য হাজী মস্তান মিয়ার মালিকানাধীন জলি এন্টারপ্রাইজ, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার জন্য সুজিত দেবের মালিকানাধীন ইকো এগ্রিকালচার স্টোর, ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন এলাকার জন্য অনুকুল চন্দ্র দাশের মালিকানাধীন জননী এন্টারপ্রাইজ, ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়ন এলাকার জন্য পলাশ দেবের মালিকানাধীন মিতালী এন্টারপ্রাইজ, ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়ন এলাকার জন্য দিপলু আহমদের মালিকানাধীন সায়মা ট্রেডার্স, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন এলাকার জন্য স্বপন কপালীর মালিকানাধীন মনমোহন ট্রেডার্স, ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন এলাকার জন্য ওয়াহিদুজ্জামানের মালিকানাধীন জামান ট্রেডার্স, ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়ন এলাকার জন্য শান্ত কপালীর মালিকানাধীন উত্তরা ট্রেডার্স এবং ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন এলাকার জন্য পরিমল দাশের মালিকানাধীন রাহুল ট্রেডার্স।

পরবর্তীকালে ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার ডিলার সুজিব দেব মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী অর্পনা দেবের নামে এবং ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন এলাকার ডিলার ওয়াহিদুজ্জামান মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী আবিদা সুলতানা চৌধুরীর নামে ডিলারশীপ পরিবর্তন করা হয়। এসব পাইকারী সার ডিলার ছাড়াও নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকায় আরো ৬৪ জনকে খুচরা সার বিক্রেতা হিসেবে লাইসেন্স প্রদান করা হয়।

খোঁজ জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকার জন্য মোমিনুল হোসেন সোহেল শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের ডিলার হাজী মস্তান মিয়া ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার ডিলার সুজিত দেবের পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুজিব দেবের স্ত্রী অর্পনা দেবের ছোট ভাই সুব্রত দেব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বাকি ডিলারদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা সমমনা দলের কর্মী-সমর্থক।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ এর ৩ ধারার ৩.২ উপধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘নিজ মালিকানায় অথবা ভাড়ায় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভায় বিক্রয়কেন্দ্রসহ কমপক্ষে ৫০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম থাকতে হবে।’ কিন্তু শ্রীমঙ্গলের কোন ইউনিয়নেই কোন বিসিআইসি সার ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্র এবং ৫০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম নেই। প্রায় সব ডিলারেরই বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম পৌর এলাকায় অবস্থিত।

??????????

খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ উপেক্ষা করে প্রায় সকল ডিলারই তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম পৌর এলাকায় স্থাপন করায় তারা (খুচরা বিক্রেতা) পৌর এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে সার নিয়ে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে হয়। পৌর এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে সার নিতে পরিবহণ খরচ বহন করতে হয় তাদের। এতে সারের গড়মূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার যখন কৃষির মৌসুম তখন কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ডিলাররা তাদেরকে সার সরবরাহ করেন না। ওই সময়ে তারা বাইরে সার অনৈতিকভাবে বিক্রি করেন। ফলে কৃষির মৌসুমে জেলার বাইরে থেকে অধিক মূল্যে তাদেরকে সার ক্রয় করতে হয়। এতে পরিবহন খরচ করে মৌসুমে অনেক সময় ক্ষতির শিকার হন তারা।

খুচরা বিক্রেতারা আরও অভিযোগ করেছেন, তারা প্রয়োজনের সময় সারের অভাবে ভুগছেন। কখনো কখনো তাদেরকে উচ্চ মূল্যে সার কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কৃষকরা জানান, মৌসুমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ডিলাররা তাদেরকে সার সরবরাহ করছেন না, ফলে অন্য এলাকা থেকে উচ্চ মূল্যে সার ক্রয় করতে হচ্ছে।

এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা ও কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ‘মূলত ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কৃষকদের সুবিধার্থে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ১০জন বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিজন সার ডিলার যে ইউনিয়নের ডিলার ওই ইউনিয়নে সার গুদামে মজুদ রেখে বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতাদের কাছে বিক্রির কথা থাকলেও গত ১৫ বছর ধরে সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে কৃষি অধিদফতরের নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এক ডিলার একাধিক সাইসেন্সের সার উত্তোলন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চড়া দামে বিক্রি করছেন।

সম্প্রতি উপজেলার ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের খুচরা সার বিক্রেতা এম. এ. রহিম, মো. নায়েব আলী, মো. ছাখাওয়াত হোসেন, মো. শফিকুল আলম রুনু, অনুকুল দেবনাথ, মো. উছমান, মো. কবির মিয়া, বদরুল আলম জামিল ও সাইফুর রহমান মুহিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগপত্রে তারা উল্লেখ করেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে একজন বিসিআইসি ডিলার আছেন। তার কাছ থেকে আমরা  ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের খুচরা বিক্রেতারা দীর্ঘ এক বছর ধরে কোন সার পাচ্ছি না। যখন পাই তখন অতিরিক্ত দামে বিসিআইসি ডিলারের কাছ থেকে সার আনতে হয়। এই ডিলারের বাড়ি আমাদের সিন্দুরখাঁন এলাকায় নয়। আমাদের ইউনিয়নের এলাকায় তার কোন দোকান বা গুদাম নেই। আমাদেরকে শ্রীমঙ্গল গিয়ে ডিলারের কাছ থেকে সার আনতে হয়।

আবেদনে তারা ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার বাতিল করে সিন্দুরখান এলাকার কারো নামে বিসিআইসি সার ডিলার দিতে ইউএনকে অনুরোধ করেন।

এদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ঘুরে এক ইউনিয়ন ছাড়া আর অন্য কোন ইউনিয়নে কোন ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের ধোবারহাট বাজারের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা ইলাছ মিয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ডিলারের কাছ থেকে প্রায় সময়ই সার পাই না। থোকাইয়া-থাকাইয়া (খোঁজে-খোঁজে) সার এনে কৃষকদের সরবরাহ করি। শ্রীমঙ্গল থেকে সার আনলে তাদের সারের দরে এবং গাড়ি ভাড়া দিয়ে সার বিক্রির কোন ক্ষমতা থাকে না।

২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নের সরকার বাজারের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা খুচরা বিক্রেতারা ডিলারের কাছ থেকে সব ধরণের সার কম পাইরাম (পাচ্ছি)। বর্তমানে সার থোরাথারা (কম পরিমাণ) পাইরাম, এখন এভেইলএভেল নাই।’ ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের শাহজীবাজারের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সব সময় সব ধরণের সার পাইনা। সব সময়ই সারের ঘাটতি থাকে। অনেক সময় বেশি মূল্যে সার কিনতে হয়।

৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের শাহজী বাজারের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সব সময় সব ধরণের সার পাইনা। সব সময়ই সারের ঘাটতি থাকে। অনেক সময় বেশি মূল্যে সার কিনতে হয়।

৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের সিন্দুরখান বাজারের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা এম. এ রহিম বলেন, ‘আমরা সারের ডিলারের কাছ থেকে প্রয়োজনের সময় সার পাই না। কিন্তু এলাকার সাধারণ কৃষকদের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে বছরের কৃষি মৌসুমে আমরা হবিগঞ্জ থেকে সার এনে বিক্রি করি। অতিরিক্ত পরিবহন খরচ হলেও আমরা এটি করে থাকি এলাকার কৃষকদের স্বার্থে। যদি আমাদের ডিলার কৃষি মৌসুমে প্রয়োজনীয় সার সরবাহ করতেন তবে আমাদের হবিগঞ্জ থেকে সার আনতে হতো না।

শ্রীমঙ্গল পৌরসভার অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা বদরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা খুচরা ডিলাররা ঠিকমতো কোন সার পাই না। আমরা সকল খুচরা ডিলার উপজেলা কৃষি অফিসারের কাছে গিয়েছিলাম আমাদের সারের বরাদ্দ জানতে। তিনি বলেছিলেন আমাদের ডাকবেন। কিন্তু এখনো ডাকেননি। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।

আশীদ্রোন ইউনিয়নের আশীদ্রোন গ্রামের কৃষক মো. মহব্বত মিয়া বলেন, ‘আমি প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে কৃষিকাজে জড়িত। আমাদের আশীদ্রোণ ইউনিয়নে সারের কোন গুদাম বা দোকান নেই। গত জৈষ্ঠ্য মাসে কোন সার পাইনি। পরিমানমতো আমরা সার পাইনি। তবে আনারস বাগান, চা বাগানে সার তারা গাড়ি বোঝাই করে দেয়। বড়-বড় বাগানের মালিকরা সার পান প্রয়োজনমতো। আমরা কৃষকরা সার থেকে অনেক সময় বঞ্চিত রয়ে যাই। ফলে কৃষিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে।

মির্জাপুর ইউনিয়নের যাত্রাপাশা গ্রামের কৃষক জাকির মিয়া এবং শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহেদ আহমদ বলেন, ‘যখন কৃষির ভরা মৌসুম তখন সারের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। সারের অভাবে কৃষিকাজ ব্যহত হয়। শ্রীমঙ্গলের তিনটি ইউনিয়ন যথা রাজঘাট, কালিঘাট, সাতগাঁও ও শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকায় কৃষি জমি নেই বললেই চলে। এ চারটি ডিলারের সার কোথায় যায়? নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বরাদ্দকৃত সার দ্বারা কৃষিজমি বিহীন তিন ইউনিয়ন ও এক পৌর এলাকা ছাড়া বাকি ছয় ইউনিয়নের কৃষকদের প্রয়োজনমতো সার সরবরাহ করতে না পারা দুঃখজনক। এছাড়া সার কিনতে গেলে অতিরিক্ত দাম রাখায় সংশ্লিষ্ট সার ডিলার পাকা কোন মেমো দেন না।

১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার হাজী মস্তান মিয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের খুচরা সার বিক্রেতাদের সব সময় প্রয়োজনমতো সার সরবরাহ করে আসছি। কেউ যদি সার পাচ্ছে না বলে থাকে তবে তা সত্য নয়।

২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার অর্পনা দেবের মুঠোফোনে কল করলে ফোনটি রিসিভ করেন তার ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত দেব। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই সারের ডিলারশীপ চালাই। সরকারিভাবে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সার খুচরা সার বিক্রেতাদের কাছে সমবন্ঠন করে থাকি। খুচরা বিক্রেতারা যদি দাবি করেন সার প্রয়োজনমতো পাচ্ছেন না তবে তাদের উচিত কৃষি বিভাগকে জানানো। আমরা সিস্টেম অনুযায়ী যেভাবে বরাদ্দ পাই সেভাবে খুচরা বিক্রেতাদের দিয়ে থাকি।

৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার অনুকুল চন্দ্র দাশ দুটি ডিলারশীপ লাইসেন্স এককভাবে পরিচালনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমার ভাই পরিমল দাশের প্রতিষ্ঠান রাহুল ট্রেডার্সের নামে ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নের ডিলারশীপ লাইসেন্স রয়েছে। সে কানে কম শুনে। তাই ভাইয়ের সারের ব্যবসাটিও আমি পরিচালনা করি। দুই ইউনিয়নের কোথাও আমাদের গুদাম নেই। শ্রীঙ্গল ইউনিয়নের সবুজবাগ এলাকায় গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র করেছিলাম। কিন্তু সার বিক্রি হয় না। তাই আমরা নতুন বাজার এলাকায় সার রাখি। এখান থেকে সহজেই সবাই সার নিতে পারেন। সারের কোন সঙ্কট নেই। যখন যার যতটুকু সার প্রয়োজন তা আমরা সরবরাহ করি।

৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার পলাশ দেব বলেন, ‘সিন্দুরখানে আমার কোন গুদাম ঘর নেই। শহরের ভানুগাছ রোডে আমার সারের দোকান রয়েছে। সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স এনে ওই ইউনিয়নের সারের ব্যবসা করছি। সিন্দুরখান এলাকায় বর্তমানে সার কম বিক্রি হচ্ছে। ফলে আমরা আশীদ্রোন ইউনিয়নের মোহাজেরাবাদ, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের রাধানগরসহ বিভিন্ন এলাকার লেবু-আনারস বাগানে সার বিক্রি করছি।

৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার দিপলু আহমদ বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে সারের কোন ঘাটতি নেই। যারা (খুচরা বিক্রেতা) অভিযোগ করেন সার পান না তারা সুযোগ সন্ধানী। কৃষির ভরা মৌসুমে তারা সার নেন বাকি সময় তাদের আর খোঁজ থাকে না। আমরা কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার সরবরাহের পর স্থানীয় লেবু-আনারস বাগানে সার দিয়ে থাকি। তারাওতো কৃষক। তারাও সার পাওয়ার দাবিদার।

৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার স্বপন কপালী বলেন, ‘আমার আশীদ্রোন ইউনিয়নের কাকিয়াপুলের কাছে আমার গুদাম আছে। সারের কোন সঙ্কট নেই। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সব সময়ই সার সরবরাহ করে আসছি।

৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার জামান ট্রেডার্সের আবিদা সুুলতানা চৌধুরী বলেন, রাজঘাট ইউনিয়নে খুব একটা কৃষিজমি নেই। ইউনিয়নে আমার গুদামঘর একটা থাকলেও সেটা ব্যবহৃত হয় না। তবে আমার নতুন বাজারের দোকান থেকে খুচরা বিক্রেতারা ন্যায্যমূল্যেই সার পাচ্ছেন।

৮ নং কালিঘাট ইউনিয়নের সার ডিলার শান্ত কপালী তার আত্মীয় নয় বা তার ব্যবসা পরিচালনা করছেন না বলে দাবি করেন। অথচ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন কর্তৃক ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট স্বাক্ষরিত বিসিআইসি সার ডিলারদের নাম ও ঠিকানার তালিকায় স্বপন কপালী ও শান্ত কপালীর সাথে যোগাযোগের একটিই মুঠোফোন নম্বর (০১৭১…..৫০) দেয়া রয়েছে।

শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সার ডিলার উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোমিনুল হোসেন সোহেলের মুঠোফেনে যোগাযোগ করলে সাড়া মিলেনি।

এমন পরিস্থিতিতে কৃষক ও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। তাদের দাবি, সারের স্বচ্ছ বিতরণ নিশ্চিত করতে এবং সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যকর করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘সিন্দুরখান ইউনিয়ন থেকে খুচরা সার বিক্রেতাদের একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আরো কিছু অভিযোগ আমাদের কাছেও রয়েছে। অনেক বিষয় আমাদেরও অজানা নয়। এসব বিষয়ে আমাদের উপজেলা পরিষদের সভায় আলোচনা করবো। দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে আমরা বড় আকারে মাঠে নামবো। যদি সার বিতরণ বা বরাদ্দে কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়, বেশি দামে সার বিক্রি হয় বা এক ব্যক্তি একাধিক ডিলারশীপ নিয়ে থাকেন তবে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া যেসব ডিলার ন্যায্য দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম সার বিক্রি করছেন খোঁজ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আবু তালেব বলেন, শ্রীমঙ্গলে বিসিআইসি সারের ডিলাররা লাইসেন্স পেয়েছেন অনেক আগেই, কিভাবে নিয়োগ ও লাইসেন্স পেয়েছেন এটি আমার জানা নেই। যদি অনিয়মের অভিযোগ পাই তদন্ত করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ লাইসেন্স পেয়ে থাকলে লাইসেন্স বাতিলের জন্য ব্যবস্থা নেবো। কিছুদিন আগে সিন্দুরখান ইউনিয়ন খুচরা সারের ডিলারদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত কররে ইউএনও বলেন অভিযোগটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমি উপজেলা কৃষি অফিসারকে বলেছি।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com