উদ্বৃত্ব বাজেট তের টাকা

June 27, 2020,

মোঃ আবু তাহের॥ এক গ্রামে একজন কৃষক বাস করিতেন। তাহার ছিল মাঠ ভরা ক্ষেতের জমি,গোলা ভরা ধান ,পুকুর ভরা মাছ এবং সুন্দর সুখি পরিবার। তিনি ছিলেন অল্প শিক্ষিত, গৌরবর্ণের,সুঠাম দেহী এবং খুব সৌখিন। কিন্তু মাঝেমধ্যে সখের বশে একটু বেশী খরচ করিতেন। সে কালে টেলিভিশন ছিল না, তাহার তিন বেন্ড ফিলিপস কাডের বাক্সের বড় একটি রেডিও ছিল। নিয়মিত খবর,পল্লীগীতি,মরমি কবি হাসন রাজার গান এবং আব্বাস উদ্দিনের ভাওয়াইয়া গান শুনিতেন। কখনো কখনো শহর থেকে কলের গান (গ্রামফোন রেকর্ডার) ভাড়া করে আনতেন এবং উচ্চস্বরে হিজ মাষ্টার ভয়েস রেকর্ড বাজাইয়া, পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে নিয়া গান শুনিতেন। “আমার স্বাধ না মিটিল আশা না পুরিল,সকলি ফুরায়ে যায় মা”আর সোনাবন্ধুর গান ইত্যাদি। তাহার স্ত্রী ছিলেন খুবই সুন্দরী,বুদ্ধিমতী ও মিতব্যয়ী,একজন সাধারণ পল্লীবধু। তিনি সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। তাহার বুদ্ধির তারিফ এলাকাসুদ্ধ সবাই করিতেন। কৃষক স্বামী স্ত্রীরির অবাধ্য ছিলেন না,স্ত্রীকে তিনি খুব ভাল বসিতেন।
একদিন স্ত্রী স্বামীকে বলিলেন,আপনার কি এখনো দাড়ি রাখার সময় হয় নাই ?দাড়ি রাখলে আপনাকে সুন্দর লাগবে।
স্বামী: – তুমি না একদিন বলে ছিলে,পুরুষ মানুষ দাড়ি রাখলে বুড়ো বুড়ো লাগে। দাড়ি রেখে বুড়ো হইব নাকি?
স্ত্রী: -হ্যাঁ বলেছিলাম ঠিকই। আপনার দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন,এখন ছেলেকে বিয়ে করাইবেন। আপনি কি জোয়ান আছেন ?
স্বামী : -রোদে জ্বলে আর গরম বাতাসে বুড়ো হইলাম নকি? আরো দিন যাক দেখা যাবে।
দিনে দিনে পরিবারের খরছ বাড়িতেছে। কোন উপায়েই আর খরচ কমাইতে পারিতেছেন না। স্বামী স্ত্রী মিলে পরামর্শ করিলেন এখন থেকে প্রতি বছর আয় ব্যয়ের অগ্রিম বাজেট করিতে হইবে। নতুবা খরচ কমানো যাইবে না। স্ত্রীরির পরামর্শ মতএকটি লিখিত কৃষি বাজেট করিলেন। অবশ্য বাজেটে কোন কিছু বাঁধ পরেনাই। আয়ের সাথে মিল রেখেই খরচের বাজেট করিলেন। হঠাৎ যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাই অতিরিক্ত খাত ও রাখা হয়েছে। বন্যা অথবা খরায় ফসল নষ্ট না করিলে বাজেটে ঘাটতির অবকাশ নাই।
কয়েক বছর যাবত বাজেট মত খরচ করায়,মোটামুটি খরচ কমেছে এবং আয় বেড়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু অতিরিক্ত খরচ হয়। দুই বছর আগে একটি হালের বলদের পা কেটে গেলে হালের অযোগ্য হয়। অচল বলদ বিক্রি করে সচল একটি কিনতে ১৭ টাকা বেশী খরচ হয়। তাহাতে অসুবিধা হয় নাই, ১৫ টাকা অতিরিক্ত বাজেট ছিল। মাত্র দুই টাকা ঘাটতি হয়। আর গেল বছর শহরে কৃষি,শিক্ষা ও বিজ্ঞান মেলা প্রদর্শনী হয়। পরিবারের ছোট বড় সবাইকে নিয়া প্রদর্শনী দেখিতে যাইয়া রাশিয়ার বিখ্যাত কমলা সার্কেস দেখেন,আসার সময় ছোট মেয়ের নামে এক টাকা দিয়ে একটি ভাগ্য লটারী ও কিনেন।
তিনি জীবনে অনেক যাত্রাগান দেখেছেন,এখন আর যাত্রাগান দেখার ইচ্ছা নাই। এবার নুতন যাত্রাপালা এসেছে “আবার বনবাসে রূপবান” সাথে একপাল ডানা কাটা পরির ঝুমুর ঝুমুর নিত্য। না দেখলে কেমন হয়। তাই স্ত্রীরির অগোচরে বন্ধুদের সাথে যাত্রা দেখতে গেলেন। এ বছর ও অতিরিক্ত বাজেট বাদ দিয়ে ২/৩ টাকা ঘাটতি হয়। যাই হোক কয়েক বছরের ধান বিক্রিরির আয় মিলিয়ে এবার এক একর কৃষি জমি কিনলেন। ইহাই তাহাদের বাজেট আনন্দ। নুতন বছরের বাজেট করতে হিমশিম খাইলেন,কারন হাতে নগদ টাকা নাই কিছু ঋণ আছে। ভরসা একটাই ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবেন। এই বছর বাজেটে অতিরিক্ত ১৫ টাকা নাই। বছরের শুরুতেই বাদসাজে,তাহার ব্যবহৃত দুইটি গামছা হারিয়ে যায়। চিন্তা করে কুলকিনারা পাইতেছেন না, গামছা কিনার সাড়ে তিন টাকা কোথায় পাইবেন। স্ত্রী চিন্তা করে সাড়ে তিন টাকা আয়ের পথ বাহির করিলেন। স্বামী প্রতি সপ্তাহে একবার ক্লিন সেভ করেন,ইহাতে তাহার আট আনা (পঞ্চাশ পয়সা) খরচ হয়। স্বামীকে বলিলেন আপনি যদি সাত সপ্তাহ সেভ না করেন তা হইলে আমাদের সাড়ে তিন টাকা আয় হইবে। আর এই টাকা দিয়ে গামছা ক্রয় করা যাবে। হ্যাঁ সুন্দর প্রস্তাব,তাই হবে। কিন্তু সাত সপ্তাহ আমাকে কেমন লাগবে ? স্ত্রী,প্রথমে একটু—পরে ভাল লাগবে। মানুষ কি দাড়ি রাখতেছে না ?
কয়েক সপ্তাহ ক্লিন সেভ করিলেন না। প্রথম কয়েক দিন বেশ অসুবিধায় ছিলেন,মুখে হাত বুলাইলেই ছোট ছোট দাড়ি হাতে লাগে আর অসহ্য চুলকানি, এযেন কেমন এক অসুখ। নিজেকে খুব অসহায় মনে করিতেন। কয়েক সপ্তাহ বাহিরে কোথাও গেলেন না। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকী,আজ তাহাকে হাঁটে না গেলে নয়। বীজ ধান বেচাকেনার মৌসুম। মেহনতি বীজ ধান নিয়ে হাঁটে গেছে তিনি ও তাহার পিছনে হাঁটে গেলেন।
তাহার পরিচিতজনেরা ভাইজান আপনার কি অসুখ ছিল ? বেশ কয়েক দিন আপনাকে হাঁটে দেখি নাই। উত্তরে না, আমি ভাল আছি। তাহলে দাড়ি রাখিয়াছেন নাকি,আপনাকে কেমন যেন লাগছে। সবাইর একি বিরক্তিকর প্রশ্ন। হাঁটে গিয়ে তিনি অবুঝের মত মানুষের মুখের দিকে তাকাইতে ছিলেন। অনেক যুবক ফ্যাশন করে দুই তিন সপ্তাহ মুখ সেভ করে নাই। কর্মজীবি অনেক মানুষ সময়ের অভাবে বা পয়সার অভাবে দুই তিন সপ্তাহ সেভ করেন নাই। তিনি চিন্তা করেন হয়ত বা আমার মত তাহাদের ছোটখাট কোন কিছু হারিয়ে গেছে। বীজ ধান বিক্রি করে, গরুর হাঁটে গেলেন। পাশেই ঘোড়া বিক্রি হয়। ঘোড়া দাম দর করিতেছে এক লোক,তাহার দিকে অবাক নয়নে তাকাইলেন। চেহারা দেখে মনে হয় লোকটি কর্মজীবি,কমপক্ষে চার পাঁচ মাসের মধ্যে চুল,দাড়িও গোঁফ কাটেন নাই। আধাপাগল অথবা খোচকরের মত দেখতে লাগে। সাহস করে জিজ্ঞাসা করিলেন,ভাই আপনার কি বড় কোন কিছু হারিয়েছে ? না ভাই হারায় নাই, মাঠ থেকে আমার জীবিকা নির্বাহের উপায় মঠ বাহক ঘোড়াটি,চুরি করে নিয়ে গেছে। বুঝতে পারছি ঘোড়ার দাম আয় করার জন্য চুল দাড়ি কাটিতেছ্ন না। বছর দিন না কাটলে ঘোড়ার দাম যোগাড় হয়ে যাবে।
কর্মজীবি : কি বলছেন ভাই বুঝতে পারি নাই।
কৃষক : ভাই দেখতেছ্ন না ছয় সপ্তাহ যাবৎ আমি মুখ সেভ করি নাই। আমার দুইটি গামছা হারিয়ে গেছে। আরো এক সপ্তাহ সেভ না করিলে,গামছার টাকা যোগাড় হয়ে যাবে।
কর্মজীবি : ভাই আপনি পাগল নাকি ?
কৃষক : পাগল হইমু কেন? ঠিক বলেছি ভাই।
কর্মজীবি : বাড়ীতে গিয়ে নিজের চেহারা একবার আয়নায় দেখেন। আমি সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকি, চুল দাড়ি কাটার সময় পাই না আর সময় পাইলে পয়সা থাকেনা। সময় পাইলে একবারে ছোট করে নিব,ছয় মাস আর চুল দাড়ি কাটা লাগবে না।
কৃষক : আপনার চেহারা ও একবার আয়নায় দেখবেন।
কর্মজীবি : চেহারা থকলে না আয়নায় দেখতাম।
বাড়ীতে এসে স্ত্রীর প্রতি একটু রাগ দেখাইলেন।
স্ত্রী : আজ আপনার কি হয়েছে ?
স্বামী : কি আর না হওয়ার বাকী আছে। হাঁটে লোকে কত কিছু বলেছে,শেষ পর্যন্ত পাগল বলেছে।
স্ত্রী : লোকের কথা শুনবেন কেন ? একবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চেহারা দেখে আসেন।
স্বামী : তুমিও দেখি একই কথা বলছ। (আয়নার সামনে গিয়) একি,আসলে আমাকে পাগলই মনে হচ্ছে। কিন্তু -আমার যে দাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে।
স্ত্রী : আর কি দেখলেন ?
স্বামী : মেঘের আড়ালে যে,বেলা শেষ। ডুবন্ত সুর্যের লাল আভা দেখেছি।
স্ত্রী : তাহলে আর দাড়ি কাটার দরকার নাই। দাড়ি রাখা যে আমাদের নবী করিম (সঃ) সুন্নত।
স্বামী : তুমি কি বুদ্ধি করে এ কাজ করেছিলে।
স্ত্রী : বুদ্ধি ঠিকই করেছি। এক সাথে দুইটি কাজ করেছি,সুন্নত ও পালন হয়েছে আর টাকা আয় করেছি। আজ থেকে যদি আর প্রতি সপ্তাহে সেভ না করেন, ৫২ সপ্তাহে বছর একবছরে ২৬ টাকা আয় হইবে।
স্বামী : তোমার হিসাবে ভুল আছে। দাড়ি রাখব নবী করিম (সঃ) এর সুন্নত। তাই বলে কি দার্শনিক বা রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের মত হয়ে যাব। সুন্নত যে ভাবে সুন্দর করে রাখতে হয় সে ভাবেই রাখব। প্রতি দুই সপ্তাহে সুন্দর করে নিয়মিত দাড়ি ছোট করব। তাহলে আমাদের বছরে ১৩ টাকা আয় হবে।
স্ত্রী : দাড়িতে কাল রং লাগাবেন না।
স্বামী : তুমি কি আরো খরচ বাড়াইতে চাও ? আমি কিন্তু দাড়িতে কাল রং পছন্দ করি না। কথায় বলে, “চোখের সুন্দর কম হলে আর কাজল দিয়ে কি হবে” আর মহান আল্লাহ তালা সাদা দাড়ি পছন্দ করেন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com