মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরিতে সংখ্যালঘু পরিবারের মাটি লুটপাটের অভিযোগ

February 7, 2023,

মাহফুজ শাকিল॥ কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের কৃষি জমি ও তিন ফসলী জমির মাটি কেটে প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরিতে থেমে নেই মাটি কাটার মহাউৎসব। আর এ কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান  অদুদ বক্স।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে জমির মালিককে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে মাটি নেয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে সরকারি কাজে ব্যবহার করার কথা বলে এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের জমি থেকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকদের সাথে যোগসাজশ করে ইউপি চেয়ারম্যান অদুদ বক্স হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

যদিও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দাবি, নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য খাস জমি থেকে এলাকার উন্নয়নের জন্য তারা এসব মাটি কেটে বাঁধ উচু করছেন। টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, মাটি কাটার সাথে জড়িত ব্যক্তি অদুদ বক্স হাজিপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হওয়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের নিরীহ লোকজন তাকে কিছু বলতে গেলেও নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনি এলাকায় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে পড়তে হয় নানা সমস্যায়।

জোরপূর্বক মাটি কাটার অভিযোগ এনে ইউপি চেয়ারম্যান অদুদ বক্সকে প্রধান আসামী করে ৫ ফেব্রুয়ারি কুলাউড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মৃত সমরেশ রায়ের ছেলে সুমিত রায়। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- হাজীপুর ইউনিয়নের ইসমাইলপুর গ্রামের বাসিন্দা ধনাই মিয়ার ছেলে মখন মিয়া ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজের মফিজুর রহমান জুয়েল ।

থানায় লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গত ৩ ফেব্রুয়ারি হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ এলাকায় সুমিত রায়সহ এলাকার বিভিন্ন লোকদের কৃষি জমি থেকে প্রভাবখাটিয়ে মাটি দিয়ে ঠিকাদারের লোকদের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি করছেন ইউপি চেয়ারম্যান অদুদ বক্স। জমির মালিকরা কোন প্রতিবাদ করলে সরকারী কাজে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে উল্টো জমির মালিকদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হয়। এরই জেরে প্রায় এক সপ্তাহ আগে রনচাপ এলাকায় সুমিত রায়ের মালিকানাধীন প্রায় ১ একর ২০ শতক জায়গার তিন ফসলী জমির মাটি চেয়ারম্যান অদুদ বক্স ও স্থানীয় প্রভাবশালী মখন মিয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়।

তারা ভেকু মেশিন দিয়ে তাদের জমির মাটি কেটে নেয়। এসময় সুমিত রায় সিলেট থাকার সুবাধে তাঁর চাচাতো ভাই বরুণ রায় স্থানীয় লোকদের নিয়ে মাটি কাটতে নিষেধ করলে চেয়ারম্যান অদুদ বক্স ও মখন মিয়া বরুণ রায়কে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে হুমকি প্রদান করে। মাটি কাটতে বাঁধা দিলে তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেন তারা। সংখ্যালঘু পরিবাবের লোক হওয়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না সুমিত রায়সহ স্থানীয় এলাকার শতাধিক পরিবার।

এদিকে জমির ক্ষতিপূরণ দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছেন স্থানীয় রনচাপ এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কুমার দাস ও মৃদুল দাস। যার অনুলিপি স্থানীয় সংসদ সদস্য, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে দেয়া হয়েছে।

তারা অভিযোগ করে বলেন, হাজীপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের রনচাপ গ্রামের সুইচ গেইটের পশ্চিম দিকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার মনু নদীর বেড়ীবাঁধের দু’পাশে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। উক্ত বাঁধের দু’পাশে তাদের প্রায় ৯০ শতক কৃষি জমি এবং বিভিন্ন প্রজাতির ২৫০টি গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে।কৃষি জমি থেকে বাঁধে মাটি দেওয়ায় জমিতে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। এই জমিতে আর কোন চাষাবাদ করা যাবে না। এতে তাদের প্রায় ছয় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ধীরেন্দ্র কুমার দাসের।

ভারত থেকে প্রবাহিত খর¯্রােতা মনু নদীকে বলা হত মৌলভীবাজারের দুঃখ। প্রতি বছরই বন্যায় প্লাবিত হতো এই জেলা। পরে নদীর দুই পাড়ের জনপদকে বন্যার তীব্রতা থেকে রক্ষা করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মনু নদীর দু,পাড়ের অন্তত কয়েকশত পরিবারের কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে বাঁধ করা হচ্ছে।

সরেজমিনে হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা সুমিত রায় ও ধীরেন্দ্র কুমার দাসের কৃষি জমির মাটি অবাধে কাটার ফলে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। তাদের ফসলি জমির মাটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মফিজুর রহমান জুয়েলসহ অন্য লোকজনের সাথে আতাত করে চেয়ারম্যান অদুদ বক্স লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া যেখানে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে সেই বাঁধের ওপর থাকা একটি সুইট গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বাঁধের নিচে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত করে নতুন আরেকটি শাখা খাল তৈরি করা হয়েছে। এতে স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করে বলছেন, বর্ষার সময় আসলে বড় বড় গর্ত থাকার কারণে প্রতিরক্ষা বাঁধটি পুনরায় ভেঙ্গে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে “মনু নদীর ভাঙ্গন হতে” মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষা প্রকল্পের আওতায় মনু নদীর বামতীরে কিঃমিঃ ১৫.০০০ হতে ২৪.৫০০ এর মধ্যবর্তী ৮৩৪০ মিটার ও কিঃমিঃ ২৭.০০০ হতে ৩২.৮০০ এর মধ্যবর্তী ৪৪০০ মিটার ৪০টি র‌্যাম্পসহ (সিঁড়ি) বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ কাজ হাজীপুর ইউনিয়নের কটারকোনা থেকে রাজনগর উপজেলার তারাপাশা পর্যন্ত ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ। কাজ শুরু হয়েছে প্রায় মাস খানেক আগে। কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ৩০ জুন।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজের মফিজুর রহমান জুয়েল বলেন, কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েই জমি থেকে মাটি নেয়া হচ্ছে। আর সুমিত রায়ের জমিটি খাস থাকায় আমরা সেখান থেকে মাটি নিয়েছি। মাটি নেয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানকে কত টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চেয়ারম্যানকে তিনি এক টাকাও দেননি।

কাজের তদারকি কর্মকর্তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ পাবেল বলেন, কোন অবস্থাতেই বাঁধের নিচ থেকে মাটি তোলা যাবে না। কাজের শিডিউল অনুযায়ী নিয়ম মেনে কাজ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মিনিমাম ৫ মিটার দূরত্ব থেকে মাটি কেটে আনতে হবে। কৃষকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি থেকে মাটি এনে বাঁধ তৈরি করতে হবে।

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান অদুদ বক্স বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। জমির মালিকদের আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা লেনদেনের অভিযোগটি সঠিক নয়।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আব্দুছ ছালেক বলেন, কৃষি জমি থেকে মাটি বিক্রির বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের আলোচনা চলছে। তাছাড়া তদন্ত করে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ ইকবাল বলেন, বাঁধ তৈরিতে কৃষি জমি থেকে মাটি নিতে হলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জমির মালিকের সাথে চুক্তি করতে হবে। জমির মালিকের সম্মতিক্রমে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার পর মাটি নেয়ার কথা। কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাটি নেয়া যাবে না।

এছাড়া বাঁধের নিচ থেকে মাটি কাটার বিষয়টি সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পেয়ে আপাতত কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছি। তাদের সাথে কথা বলে নিয়ম মেনে কাজ করার পরামর্শ দিবো। বাঁধ তৈরিতে কৃষকদের ঠকিয়ে কেউ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ নেই।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com