মহান মে দিবসে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের ঘোষণা ‘শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল দূর্যোগ ও দুর্ভোগ লাঘবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার’
স্টাফ রিপোর্টার॥ করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে মহান মে দিবসের ১৩৫-তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটি প্রেরিত ঘোষণা পাঠ করার মাধ্যমে মৌলভীবাজারে দিবসটি পালন করা হয়।
এ উপলক্ষে ১ মে শুত্রুবার সকাল ১০ টায় নিজ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভবাজার জেলা কমিটির সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীন ঘোষণা পাঠ করেন। সভাপতির আহ্বানে একই সময়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঘোষণাটি পাঠ করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহবায়ক অবনী শর্ম্মা, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির আহবায়ক দেলোয়ারা বেগম, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ মৃগেন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মোঃ মোস্তফা কামাল, সহ-সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, প্রচার সম্পাদক শাহজাহান আলী, মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ সোহেল মিয়া, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ তারেশ বিশ্বাস সুমন, হোটেল শ্রমিকনেতা ইউসুফ মিয়া, আব্দুস সালাম, আল আমিন, মহিলানেত্রী আম্বিয়া বেগম, রিকশা শ্রমিকনেতা মাহমুদুর রহমান ও রিপন মিয়া প্রমূখ।
সমগ্র কর্মসূচিটি সমন্বয় করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস। ঘোষণা পাঠ করার মাধ্যমে নেতৃবৃন্দ অঙ্গীকার করেন- আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান মহামারী মহাদূর্যোগ এবং আগত মহাদুর্ভিক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে শ্রমিক শ্রেণীকে। আসুন এই পরিবর্তিত পরিবেশে এবারের মহান মে দিবসে আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করি-শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল দূর্যোগ ও দুর্ভোগ লাঘবে আমরা সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দৃঢ় পদক্ষেপে অর্জিত অধিকার রক্ষা ও নতুন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যাবোই যাবো।
মহান মে দিবস–এর ঘোষণা
শ্রমিক শ্রেণীর রক্তঝরা সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মহিমায় মহিমান্বিত সংগ্রামের প্রতীক হচ্ছে ১লা মে “মহান মে দিবস”। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে রক্তঝরা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শ্রমিক শ্রেণীকে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। শ্রমিক শ্রেণীর ছোট বড় বিচ্ছিন্ন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যূথবদ্ধ ও সংগঠিত রূপের আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সমাবেশের মাধ্যমে। সেই সমাবেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকারের পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনীর নির্মম দমন পীড়নের প্রতিবাদে ১ মে শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালে পুলিশ ও বুর্জোয়াশ্রেণীর দালালদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন ৬ জন শ্রমিক এবং শত শত শ্রমিক আহত হন। এর প্রতিবাদে ৪ মে হে মার্কেটের সামনে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ সভা চলাকালীন সময়ে পুলিশের পৈশাচিক গুলিবর্ষণে নিহত হন ৭ জন শ্রমিক এবং হতাহত হন অনেকে। ৮ ঘন্টা শ্রম দিবসের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার কারণে পুলিশ গ্রেফতার করে অগাষ্ট স্পাইজ, সীমফেল্ডেন, মাইকেল, জর্জ এঞ্জেল, এডলফ ফিশার, লুই নিংগ এবং অস্কার নিবে- এই ৭ জন শ্রমিক নেতাকে। বুর্জোয়াশ্রেণী ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ফাঁসির আদেশ দেয় শ্রমিকশ্রেণীর নির্ভীক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বীর নেতা অগাষ্ট স্পাইজ, পারসন, ফিশার, জর্জ এঞ্জেলকে।এই সব বীর শ্রমিক নেতারা সেদিন সৃষ্টি করেন আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী দৃঢ়তার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। প্রতিষ্ঠিত হয় ৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘন্টা বিনোদন ও ৮ ঘন্টা বিশ্রামের সময়সীমা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে মহান মে দিবস।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি যে কত ভংগুর এবং ধ্বংসন্মোখ তা প্রমাণিত হয়েছে বিগত দুইটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যদিয়ে। একচেটিয়া লগ্নি পূঁজির বিভিন্ন কর্মসূচি বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, শোভন কাজ, শোভন কর্মপরিবেশ সবই আজ প্্রশ্নবিদ্ধ। ‘শতাব্দীর উন্নয়ন কৌশল’ এবং ‘টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা’ এসব কোন কর্মসূচিই রক্ষা করতে পারবেনা পুঁজিবাদের অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি। মুনাফাকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা আজ ব্যর্থ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাস তথা কভিড-১৯ এর মহাদূর্যোগকে মোকাবেলায়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সমন্বিত হওয়ার বদলে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ভিতরে বিরোধ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশেও প্রায় লকডাউন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রমিক- জনগণের দায়িত্ব নেয়ার বদলে কারখানা বন্ধ, ছাঁটাই, লে-অফ, চাকুরিচ্যুতির মহামড়কে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষদের এক দুর্বিষহ অনাগত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবার রফতানিমুখী শিল্প রক্ষার নামে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জীবনের ঝুঁকি বিষয়ে কোন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ ছাড়াই কারখানা খুলে শ্রমিকদেরকে নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার স্বার্থরক্ষাকারী শিল্প মালিকদের বিশেষতঃ গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য নামেমাত্র কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তথাকথিত ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচির ফলে এসব প্রণোদনা কতখানি শ্রমজীবী মানুষদের রক্ষা করতে পারবে এই প্রশ্ন সর্বত্রই জাগছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার, মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য আমদানিকৃত সামগ্রী পরিবহনের কাজে নিয়োজিত নৌ-যান ও সড়কে পরিবহন কাজে ও লোডিং আনলোডিং কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপতো নাই-ই; এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিবেশ কাজ করার জন্য তাদের নেই কোন স্বীকৃতি বা তাদের জন্য নেই কোন স্বাস্থ্য বীমা বা আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা। বিশ্বব্যাপীই এই করোনা মহাদূর্যোগ মহাদুর্ভিক্ষের ঘন্টা ধ্বনি বাজাচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব তথা বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর সামনেও আজ এক
বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলার জন্য শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী মানুষকে এককাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। আসুন নিজের অধিকার সংরক্ষণ ও নতুন ভবিষ্যতের জন্য শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালাল পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে অগ্রসর করে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি।
প্রচলিত দান-দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যবস্থা নয়, আসুন আমরা দরিদ্র পীড়িত কর্ম বঞ্চিত সকল মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা ও বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, করোনায় মৃত্যুবরণকারী সকল শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পরিবার পরিজনের বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, ছাঁটাই, লে-অফ, চাকুরিচ্যুতি বন্ধ, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান, পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা, বাঁচার মত মজুরি, প্রবাসে কর্মরত এবং কোভিড-১৯ এর কারণে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, দরকষাকষির অধিকার শোষণ-জুলুম-নির্যাতন বন্ধের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করি।
আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান মহামারী মহাদূর্যোগ এবং আগত মহাদুর্ভিক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে শ্রমিক শ্রেণীকে। আসুন এই পরিবর্তিত পরিবেশে এবারের মহান মে দিবসে আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করি-শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল দূর্যোগ ও দুর্ভোগ লাঘবে আমরা সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দৃঢ় পদক্ষেপে অর্জিত অধিকার রক্ষা ও নতুন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যাবোই যাবো। পথ যতই আঁকাবাঁকা হোক, শ্রমিক শ্রেণীর জয় অনিবার্য।
মন্তব্য করুন