রুমানার পরিবার ও সুজা মেমোরিয়াল কলেজ-১

সায়েক আহমদ॥
‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’
‘জন্মিলে মরিতেই হইবে।’
‘মৃত্যু চিরন্তন।’
এরপরও কিছু কিছু মৃত্য মানবহৃদয়ে গভীর দাগ কেটে যায়। এরকমই একটি মৃত্যুসংবাদ হৃদয়কে আলোড়িত করল। কাজেই কিছু লিখতেই হল।
গত ২৭.৬.২০২০ ইং, শনিবার ভোর সাড়ে ৬টায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুজা মেমোরিয়াল কলেজের সম্মানিত ভূমিদাতা বিশিষ্ট দানবীর বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদ এর ছোট মেয়ে রুমানা আহমেদ রুমা।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
সারাবিশ্বের ছোট-বড় সকল দেশেই করোনা সংক্রমণের মহামারী চলছে। গরীব-ধনী, যুবক-বৃদ্ধ, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবাই ঘাতক ব্যাধি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের সাথে প্রবল যুদ্ধ করে সুস্থ হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। রুমানাও করোনাক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানী স্কয়ার হাসপাতালে। ছিলেন ভেন্টিলেশনে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করেও এর ভয়াল থাবার হাত থেকে রক্ষা পাননি। তাকেও চলে যেতে হল না ফেরার দেশে। তাঁর অকালমৃত্যুতে শমশেরনগরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
বয়সের কারণে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদ (অব:) এখন শয্যাশায়ী। সবরউদ্দিন সাহেবের স্ত্রীও অসুস্থ, হুইলচেয়ারে বসেই চলাফেরা করতে হয়। এ দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিলেন তানভীর আহমেদ সুজা। তিনি ছিলেন বুয়েটের ছাত্র। কিন্তু ১৯৯৩ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে এ মেধাবী শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যু হয়। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে এ পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে ছিল শোকাচ্ছন্ন। বড় মেয়েও বিদায় নিয়েছেন অনেক আগেই। বড় মেয়ে নিপার স্বামী ছিলেন হাইকোর্টের আইনজীবি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর কাকে বলে! তিনিও করোনাক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই ছোট মেয়ে রুমানাও চলে গেলেন অকালে। এতগুলো মৃত্যুর মিছিলে সবরউদ্দিন দম্পতি আজ বাকরুদ্ধ। বাকরুদ্ধ তাদের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন। স্তব্ধ হয়ে গেছেন শমশেরনগরবাসী। এত মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠা কি সম্ভব! এ পরিবারটির উপর যেন নেমে এসেছে ধারাবাহিক হৃদয়বিদারক ঘটনাপ্রবাহ। রুমানা প্রথম আলো পত্রিকার কমলগঞ্জ প্রতিনিধি অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান রঞ্জু, মৌলভীবাজার জজকোটের এডভোকেট হাবিবুর রহমান মুকুল, ঢাকার বিশিষ্ট ট্রাভেল ব্যবসায়ী মুহিবুর রহমান টুটুল এবং শমশেরনগরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুর্শেদুর রহমান সেজুর চাচাতো বোন।
একসময়ের বিমানবাহিনীর অকুতোভয় সৈনিক অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদ বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়েছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দীর্ঘদিন নীরব হাহাকারে দিন কেটেছে সবরউদ্দিন দম্পতির। বড় মেয়ে এবং জামাতার মৃত্যুর পর রুমানাই ছিলেন এ দম্পতির একমাত্র অবলম্বন। রুমানাও বৃদ্ধ পিতামাতাকে নিজের কাছে রেখে দেখভাল করছিলেন, অসুস্থ পিতামাতার সেবাযত্ন করছিলেন। কিন্তু সেই রুমানাও আজ সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। এ দুঃখ সহ্য করা কতই না কঠিন তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন সবর উদ্দিন আহমদ দম্পতি। শমসেরনগরের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই পরিবারের প্রতি সর্বমহল গভীর সমবেদনা জানাচ্ছেন। যদিও রুমানার পরিবারের পক্ষে এই মৃত্যুকে মেনে নেয়া সহজ নয়। শমশেরনগরবাসীর হৃদয়ও আজ রুমানার মা-বাবার জন্য ব্যথিত। সত্যিকার অর্থে চোখের সামনে তিনটি সন্তান মারা যাওয়ার দৃশ্য সহ্য করা যে কোনও পিতামাতার কাছে পর্বতের চেয়েও কঠিন।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন