হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্তরা বিপাকে : এখনও ত্রাণ পৌঁছায়নি

স্টাফ রিপোর্টার॥ ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো পাননি সরকারী ত্রাণ সহায়তা। এমন অভিযোগ এখন হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্থদের। চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় হাকালুকি, কাউয়াদিঘি, হাইল হাওর সহ জেলার ছোট বড় হাওর পাড়ের বাসিন্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। হাওর পাড়ের ক্ষতিগ্রস্থ বোরো চাষী ও জেলেরা এখনো পাননি কোন সরকারী সহায়তা। এমন অভিযোগ করছেন হাওর পাড়ের অসংখ্য বারো চাষী ও জেলে। হাকালুকি হাওর তীরের মৌলভীবাজার অংশের ৩ উপজেলায় নেই কোন ন্যায্য মূল্যের দোকান। দু’দফা ত্রাণ বিতরণ হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়নি সরকারি সহায়তা বা ত্রাণ। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও হাওর তীরের কৃষকরা সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় হতাশ। হাকালুকি হাওর তীরে অবস্থিত কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষীদের সাথে আলাপে এমনটিই জানালেন তারা। তারা জানালেন হাওর তীরের কোন উপজেলায় ন্যায্যমূল্যের দোকান বা ওএমএস’র দোকান এখনও চালু হয়নি। তাছাড়া স্থানীয় বাজার গুলোতেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। খুচরা বাজারে কোন চালই ৪৫ থেকে ৫০ টাকার কম নেই। প্রতিদিনই ১০-১৫ সদস্যের পরিবারে ৪-৫ কেজি চালের প্রয়োজন। এছাড়া অনান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষত রয়েছেই। এবছর আগাম বন্যায় সর্বস্বান্ত কৃষক এ নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। খাদ্য ও বাসস্থান সংকটে ইতোমধ্যে গরু, মহিষসহ গবাদি পশু গুলো বিক্রি করেছেন। বেঁচে থাকার সব উপকরণ হারিয়ে এখন তারা চূড়ান্ত অসহায়।
জেলা ত্রাণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায় এ পর্যন্ত জেলার ৬৭টি ইউনিয়নের মধ্যে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নের সংখ্যা ৬০টি। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২৪,৮৭১টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯,৭২৩টি পরিবার। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১,২১,৬০৬ জন ও আংশিক ২,৫৮,৩৪৮ জন। মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৯শ’ ৫৪ জন। সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ৮৯১টি ও আংশিক ৫,৯১০টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮,৮৯৮ হেক্টর জমির বোরো ফসল। মাছ মরেছে ২৫ টন। তবে প্রতিদিনই এই ক্ষয়ক্ষতির হালনাগাদ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ফসল হারানো দুর্গত মানুষদের জন্য জি আর ২০০ টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। যা ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ৩ মাস ৮ দিনের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১ হাজার ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে ৯৮ টন চাল ও ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। এই ১ হাজার কৃষক মাসে পাবেন ৩০ কেজি চাল আর নগদ ৫০০ টাকা। নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৫০০ টন চাল ও ১০ লাখ টাকা, ১০০০ বান্ডিল ঢেউটিন সহ ও আনুপাতিক হারে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নে ওএমএস চালের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
হাকালুকি হাওরের ভুকশিমইল ইউনিয়নে সাদিপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ছত্তার মিয়া (৫৫), আবুল হোসেন, ইমাম উদ্দিন (৩২), তাহির মিয়া (৬০), ইসমেত মিয়া (৩৮), জুনেদ আহমদ (৪৮), গণেশ চন্দ (৫৮), গোপী শীল (৬২), বাতির মিয়া (৪৮), রোমান আহমদ (১৮), লীলামতি বেগম (৪৮) গুলজার মিয়া (৬৮) গোলবান বিবি (৬২), রেণু বেগম (৪৫) জানান, ৩ বিঘা থেকে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমিতে বোরো ধান ক্ষেত করলাম। জমিতে কাঁচি নিয়ে নামতে পারিনি। শুনলাম সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের কৃষককে চাল ও নগদ অর্থ দিচ্ছে। শোনেছি দু একজন পেয়েছে। কিন্তু এখনোত আমরা পেলাম না। তারা বলেন আমরা ইউনিয়নে সাহায্য নেওয়ার জন্য যান না। ফলে বঞ্চিতের তালিকায়। তাদের অভিযোগ, যারা সারা বছর সরকারি সাহায্য পায় তাদের যেন কপাল খুলেছে।
বরমচাল ইউনিয়নের কয়ছর উদ্দিন জানান, ২৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন । কিছু পচা ধান তুলে তা থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়, সেই আশায় পচা ধান ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। সরকারি সাহায্য বলতে তাকে ইউনিয়ন থেকে ২০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে এনে ওজন করে দেখা যায় ১৭ কেজি ৪শ গ্রাম চাল হয়েছে। ৪ জনের সংসারে ১৭ কেজি চালে ২-৩ দিন চললো। এরপর কি করবেন? এই ইউনিয়নের আলীনগর, মাধবপুর, উত্তর ভাগ, আকিল পুর, উছমানপুর এই এলাকার মানুষ বোরো চাষের উপর নির্ভরশীল।ভাটেরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, হাকালুকি হাওর তীরের ভুকশিমইল ও ভাটেরা ইউনিয়ন অধিকাংশ বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। মাত্র ৯টন চাল তিনি বরাদ্দ পেয়েছেন। মাত্র ১০ কেজি করে ১৮ শ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে ৯শ জনকে দিয়েছেন। দ্রুত ওএমএস চালুর দাবি জানান তিনি। দূর্গত মানুষকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী প্রদান ও হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে তারা আন্দোলনে নামছেন। ইউনিয়নের বেড়কুড়ি, শাহমীর, খামউরা, নওয়াগাঁও, শরীফপুর গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির দরিদ্র মানুষ, কৃষক ও জেলে মিলিয়ে ১৪শ জনকে সাড়ে ১৫ টন চাল ও ২২০ জনকে নগদ টাকা প্রদান করেছেন। তাঁর ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন গুলোর চেয়ারম্যানরা জানান, তাদের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বরমচাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহবাব হোসেন চৌধুরী শাহজাহান ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় ক্ষমতার দাপট খাঁটিয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম জানান, মৌলভীবাজার জেলায় ওএমএস এর দোকান নেই। দোকান চালুর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছি। বিগত যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করার কথা। সেই নির্দেশনাও দেওয়া ছিলো। ত্রাণ বিতরণে কোন ধরনের গাফিলতি ও স্বজনপ্রীতি না হয়, সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
মন্তব্য করুন