আমার দেখা একজন আদর্শ প্রধান শিক্ষক

October 1, 2023,

আমি একজন শিক্ষকের কথা বলছি যিনি আমার দেখা আদর্শ মানুষ গুলোর মধ্যে অন্যতম। যিনি অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। যিনি ছিলেন পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী।

তিনি হলেন আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার কুলাউড়া, মৌলভীবাজার এর সকলের প্রিয়মুখ একজন নিবেদিত প্রাণ পুরুষ চুনঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম জনাব মোঃ জয়নাল আবেদীন। যার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজারে।

তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ২৫শে মে ১৯৭০খ্রি.।  পিতার নাম মোঃ দরছ মিয়া। মাতার নাম মোছাম্মৎ খয়রুন্নেছা। তিনি ১৯৯৮ সালের ২৮ এপ্রিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে যোগদান করেন। চাকুরীরত অবস্থায় অধ্যবসায়ী ও জ্ঞান পিপাসু মোঃ জয়নাল আবেদীন ২০০০খ্রি. এমএ ২০১১ খ্রি. বিএড ডিগ্রী লাভ করেন।

শিক্ষকতা জীবনে তিনি সিইনএড ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ , বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, লিডারশীপ প্রশিক্ষণ, একাডেমিক সুপারভিশন প্রশিক্ষণ গস্খহণ করেন।

তিনি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ (প্রাথমিক বিজ্ঞান) এর প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০০৫ খ্রি. সহকারি শিক্ষক হতে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১১ খ্রি. এর ১৭ ফেব্রুয়ারি চুনঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

তৎকালীন সময়ে বিদ্যালয়টি ছিল উপজেলার এশটি অবহেলিত স্কুল। প্রধান শিক্ষকসহ ০৪ জন শিক্ষক ও ১৪০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তিনি অনুধাবন করেন বিদ্যালয়টির পরিবেশ লেখাপড়ার অনুকুল নয়। অভিভাবকগণ তাই সন্তানকে এই বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করেন।

তার প্রথম এসাইনমেন্ট হিসেবে বিদ্যালয়ের বেছে নেন পরিবেশকে শিশু বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে ক্যাচমেন্ট এলাকার অভিভাবকদের মন জয় করে এলাকাবাসির সহযোগিতা , তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার জনাব মোঃ শরীফউল ইসলাম এর প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনা ও বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের আর্থিক অনুদান নিয়ে বিদ্যালয়ের পরিবেশকে আকর্ষণীয় করে তোলেন।

তাঁর অদম্য চেষ্টায় ২০১৫ খ্রি.উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তী ২০১৬ সালেই বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।

২০১৬ খ্রি. তার মেন্টরিং এর মাধ্যমে বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা জনাব সঞ্চিতা রানী দেব উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হয়েছেন।

একজন আদর্শ প্রধান শিক্ষক হিসেবে যে সকল গুণ থাকা আবশ্যক প্রায় সব গুলো গুণই তাঁর মাঝে বিদ্যামান ছিল ।

যেমন: প্রমিত উচ্চারণে আকর্ষণীয় ভাষায় কথা বলা, নিজে উন্নত বিদ্যালেয়ের স্বপ্ন দেখা ও অপরকে দেখানো, আত্নসচেতন হওয়া, আত্ম বিশ্বাসী হওয়া আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হওয়া, সকল কাজে সৎ থাকা, মানবিক থাকা, দায়িত্বশীল হওয়া, নিজ জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও জীবন বোধদ্বারা অনুসারীদের প্রভাবিত করতে পারা, নিজের কর্মক্ষেত্র সর্ম্পকে যথেষ্ঠ জ্ঞান থাকা ও দক্ষ হওয়া, নিয়মানুবর্তিতা চর্চা করা, শিক্ষাক্রম সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা থাকা, শিক্ষার্থী বান্ধব হওয়া, সহকর্মীদের প্রেষণা তৈরীতে সক্ষমতা থাকা, স্টেকহোল্ডার দের সাথে কার্যকর যোগাযোগের দক্ষতা থাকা, চিন্তা ও মনে প্রগতিশীল হওয়া,ধৈর্যশীল হওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পারদর্শী সদুরপ্রসারী ভাবনা থাকা-বিচক্ষণ হওয়া, পেশার প্রতিসন্তুষ্ট ও ভালবাসা থাকা, পরিশ্রমী হওয়া, বিভিন্ন পরিস্থিতি বিশ্লেষণে পারদর্শী হওয়া, সমালোচনা গ্রহণে নিরপেক্ষ থাকা, অন্যেও প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিচক্ষণ হওয়া, সময় সচেতন হওয়া কার্যকর ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী , নতুন পরিবর্তন গ্রহণে ইতিবাচক থাকা, নিজজ্ঞান ও দ্ক্ষতা উন্নয়নে আগ্রহী থাকা, রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা ইত্যাদি।

তাঁর বিদ্যালয়ে ইনোভেশন কার্যক্রম চালু করেন। জাতীয় পর্যায়ে ২০১৮এ সফল উদ্ভাবক । ইনোভেশন মেলা ও শোকেসিং ২০১৯এ উদ্ভাবনী আইডিয়া (মোবাইল মাসী) এর জন্য সেরা উদ্ভাবক। ইনোভেশন আইডিয়া“ পারিবারিক দিক্ষাই শিশুর নৈতিক শিক্ষা”। ২০১৯ তাঁর সেরা নির্বাচিত পরিপত্র।

তাঁর এই ইনোভেশন কার্যক্রম সমূহ ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২০খ্রি. প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ইনোভেশন টিম, ২৫শে মে ২০২২ খ্রি. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ইনোভেশন টিম ও সর্বশেষ ২৮শে মে ২০২৩ খ্রি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জনাব সৈয়দ মামুনুল আলম বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। সকলে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

তাঁর প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এ বছর জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২৩ খ্রি. এর বাছাই প্রতিযোগিতায় মৌলভীবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত  হয়েছেন অত্র বিদ্যালয়েরই সহকারী শিক্ষক জনাব মোঃ আব্দুল হান্নান।

এ অদম্য আদর্শ মানুষটিই গত ১১/০৮/২০২৩ খ্রি. শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজরত অবস্থায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ কওে চলে গেলেন। রেখে গেলেন তার শিক্ষিকা স্ত্রী ও ২ সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী।

তাঁর অশাল মৃত্যুতে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার কুলাউড়া, মৌলভীবাজার এর অপূরণীয় ঘাটতি হলো। সকলে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

প্রাথমিক শিক্ষাক সকল শিক্ষক তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন।

আমরা প্রত্যয় গ্রহণ করি তার মত একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার। তিনি মৃত্যুবরণ করেও আমাদের হৃদয়ে আজীবন অমর হয়ে থাকবেন।

লেখক : মহিব উল্যাহ, ইন্সট্রাক্টর উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার। ইমেইল: mohibinsurcdpe@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com