বড়লেখায় সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মজিদ মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

আব্দুর রব : বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও খাজনা পরিশোধে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ঘুস আদায় ও সেবা গ্রহীতাদের অযথা হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে ‘বড়লেখায় তহশিলদারের ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হলে তোলপাড় শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই তহশিলদারের ঘুস দুর্নীতির অভিযোগের কোনো তদন্তই করেনি। এতে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুস বাণিজ্যে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিনিধি আবু হাসান, ভোক্তভোগী হুমায়ুন কবির, জাহেদুর রহমান জাহেদ, জাহাঙ্গীর হোসেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মজিদ মিয়ার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের সাথে তারা যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদের কপিটিও সংযুক্ত করে দেন।
অবশেষে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার নির্দেশে বুধবার সকাল এগারোটায় অভিযোগের তদন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অভিযোগের তদন্ত করছেন মৌলভীবাজারের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর শারমিন সুলতানা।
জানা গেছে, বড়লেখা সদর ভূমি অফিসের তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়া রীতিমতো ফাঁদ পেতে ঘুস আদায় করছেন। ভূমি মালিকদের সঙ্গে রফাদফা হলেই যৎসামান্য ভূমি উন্নয়ন করের রশিদ কাটেন। তার ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে একাধিকবার ভোক্তভোগী ভূমি মালিকগণ জেলা প্রশাসক, মৌলভীবাজার বরাবর অভিযোগ দিলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবের পরেও তিনি দুর্দান্ত প্রতাপে তার অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এসব অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা খাজনা দিতে আসা লোকদের নানা অজুহাতে হয়রানি করেন। ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ে নামজারি পর্চা ও খাজনা পরিশোধের রশিদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় খাজনা পরিশোধ করতে গেলে প্রথমে বিরাট অঙ্কের টাকার সমন্বয় করে দেন। এরপর দর কষাকষির পর যৎসামান্য টাকার ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেন। সারাদেশের অন্যান্য উপজেলায় ‘আগে নামজারি পরে খাজনা’ পরিশোধের নিয়ম থাকলেও মজিদ মিয়া বড়লেখায় যোগদান করেই এসিল্যান্ডকে প্রভাবিত করে ‘আগে খাজনা পরে নামজারি’ প্রথা চালু করেন। আবেদনকারীগণের খাজনা পরিশোধ করা না থাকলে এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের দোহাই দিয়ে তিনি নামজারি রিপোর্ট নেতিবাচক প্রদান করেন। অনেকেই অভিযোগ করেন সামান্য কয়েক শতক ভূমি ক্রয় করার কারণে বাধ্য হয়ে তাদের আগের ভূমি মালিকের বকেয়া ৩০-৪০ বছরের সমস্ত খতিয়ানের কয়েক একর ভূমির খাজনা দিতে হয়। আবার তার চাহিদামত টাকা দিয়ে দিলে খাজনা ছাড়াও তিনি নামজারি রিপোর্ট প্রদান করেন।
অভিযোগকারী হুমায়ুন কবির সম্প্রতি ভূমি অফিসে তার পিতার নামীয় ভূমির নামজারি করতে যান (যার আবেদন নম্বর ৩০৪১১৩৭ ), নামজারি মামলা নম্বর ১৮৮/২৪-২৫। কিন্তু তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়া হুমায়ুন কবিরের আবেদনে সকল ডকুমেন্টস সঠিক থাকার পরেও হয়রানি করে ঘুরাতে থাকেন। এরপর নানা ভুল দেখিয়ে নামজারি আবেদন বাতিলের প্রস্তাব সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর প্রেরণ করেন। তার মিথ্যা-হয়রানিমূলক রিপোর্টের কারণে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নামজারি আবেদন বাতিল করেন। পরবর্তীতে তিনি আবেদনটি বিবেচনার জন্য হালনাগাদ আবেদন করেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছে গেলে তিনি পুনরায় যাচাই-বাচাই করে দেখেন আবেদনে কোনো ত্রুটি নেই। নামজারি আবেদনটি সঠিক ছিল। পরে এসিল্যান্ড পুনরায় নামজারি আবেদনটি সক্রিয় করে পুনরায় তহশিলদারের কাছে পাঠিয়ে পুনঃতদন্ত রিপোর্ট এনে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি নামজারিটি সম্পন্ন করে দেন।
ভোক্তভোগী হুমায়ুন কবির বলেন, শুধুমাত্র অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য হয়রানিমূলক মিথ্যা রিপোর্ট প্রদান করে ২৮ দিনের নামজারির সম্পন্নের জায়গায় প্রায় ৭ মাস অযথা হয়রানি করেন তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়া। তিনি প্রতিনিয়ত এভাবেই সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে যাচ্ছেন।
অপরদিকে জাহেদুর রহমান জাহেদ বলেন, চলতি বছরের ১০ এপ্রিল আমার নিজ গ্রাম বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মহদিকোনায় ৩টি এক্সেভেটর ও ৬/৭টি ট্রাক্টর দিয়ে অবৈধভাবে ফসলি কৃষি জমির মাটি কেটে পরিবহন করতে দেখে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আসলাম সারোয়ার মহোদয়কে অবগত করি। ঘটনাস্থলের ভিডিও এবং ছবি উনার হোয়াটসঅ্যাপে প্রেরণ করি। তিনি সরকারি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় বড়লেখা সদর ইউনিয়নের তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়াকে ঘটনাস্থলে পাঠান। কিন্তু মোহাম্মদ মজিদ মিয়া পথিমধ্যে মাটি কর্তনকারীদের সাথে যোগসাজসে তাদেরকে বিষয়টি অবহিত করে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে চলে যেতে বলেন। এসিল্যান্ডকে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জানান, এখানে মাটি কাটার ঘটনাই ঘটেনি বলে আমাকে এসিল্যান্ডের নিকট মিথ্যাবাদী বানিয়ে দেন। অন্যদিকে অবৈধ মাটি কর্তনকারীগণ প্রচার করে বেড়ায় সদর তহশিলদার মজিদ মিয়া তাদের লোক। তাদের কাজে কেউ বাধা দেওয়ার নেই।
জাহেদুর রহমান জাহেদ আরও বলেন, মজিদ মিয়ার এভাবে অপরাধীদের সাথে আতাত করে চলা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং অপরাধীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার কারণে সমাজের প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধীরা আরও অন্যায় কাজ করার সাহস পাচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে এসিল্যান্ড-ইউএনও-ডিসি মহোদয়সহ প্রশাসন/সরকারের বদনাম হচ্ছে। আমরা উনার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
অপর ভোক্তভোগী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, আমার এক আত্মীয় নাজারির আবেদন করার পর বারবার নামজারি রিপোর্টের জন্য তহশিলদারের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু তিনি নামজারি রিপোর্ট প্রদান না করে আমাকে দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকেন। আমার সকল কাগজপত্র অনলাইনে সাবমিট করার পরও আমাকে দলিলপত্রের ফটোকপি পুনরায় তার কাছে জমা দিতে বলেন। আমি কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও তিনি রিপোর্ট না দিয়ে আমাকে হয়রানি করেন। একপর্যায়ে এপ্রিল মাসে এসে তিনি জানান কাগজপত্র মূলকপি থেকে স্ক্যান করে আপলোড না করায় নামজারি বাতিলের জন্য এসিল্যান্ডের নিকট রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছেন। আমাকে নতুনভাবে আবেদন করতে বলেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, আমি জানুয়ারি মাসে ফের আবেদন করি। আমার কাগজপত্র ঠিক না থাকলে এরমধ্যে আমাকে তিনি জানাতে পারতেন। আমি সাথে সাথে নতুন করে আবেদন করতে পারতাম। আমাকে ৩ মাস অযথা হয়রানি করা হয়। উনার কথামতে আমি আবার নতুন করে চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আবেদন দাখিল করি। যার আবেদন নং ৩৩৬৬৫৯৯, নামজারি কেস নং ৬৩৯১/২০২৪-২৫। নতুন নামজারির রিপোর্ট এর জন্য আবার বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মজিদ মিয়া আবারও আমাকে হয়রানি করেন। দলিলপত্রের ফটোকপি উনার কাছে জমা দিতে বলেন। আমি আমার আগের একই ভূমির আবেদনে দলিলপত্রের ফটোকপি উনার কাছে জমা দিয়েছিলাম। একথা বললে উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং কাগজপত্রের ফটোকপি উনার কাছে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানান। বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার অযথা আমাদেরকে হয়রানি করেন। তার এরকম হয়রানির কারণে সরকারের ভাবমুর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। সাধারণ জনগণ তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মজিদ মিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।
মৌলভীবাজারের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর শারমিন সুলতানা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিনিধিসহ চার ভোক্তভোগীর লিখিত অভিযোগের তদন্তের শুনানি বুধবার তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। তিনি অভিযুক্ত তহশিলদার ও চারজন অভিযোগকারিকে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত শুনানিতে স্বপক্ষের প্রমানাদিসহ উপস্থিত হতে নোটিশ প্রদান করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত তহশিলদার মোহাম্মদ মজিদ মিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। রিং বাজলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন