রাজনগরে লাল বর্ণে আবির্ভূত হন দুর্গাদেবী ১৩৭ টিমন্ডপে পূজা হবে
আউয়াল কালাম বেগ : ৯ অক্টোবর বুধবার ষষ্ঠীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহা উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার উপমহাদেশের একমাত্র পাঁচগাঁওয়ে মন্ডপে দুর্গাদেবী লাল বর্ণে আবির্ভূত হন। এ বছর রাজনগর উপজেলায় ব্যক্তিগত ৬২ ও সার্বজনীন ৭৫ টি মিলে মোট ১৩৭ টি মণ্ডপে শারদীয় দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
পূজা ঘিরে ঘরে- বাইরে চলছে চরম ব্যস্ততা। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সঙ্গে রাত-দিন সমান তালে কাজ করে রংতুলির আঁচড়ে দেবীকে প্রতিমা শিল্পীরা সাজিয়েছেন এক অপরূপ রূপে। পাঁচগাওয়ের মন্ডপে দুর্গার রং লাল হওয়ায় দেবী দর্শনের জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও অনেক পূণ্যার্থী ছুটে আসেন এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পূজো দিতে আসেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তরা। দেশের বাইরে থেকে বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও ভক্তরা আসেন এখানে। লাল বর্ণের দেবী দুর্গার পূজা উপমহাদেশের আর কোথাও হয় না। অষ্টমী ও নবমীর দিন এতো ভক্তের আগমন ঘটে যে, সারিবদ্ধভাবে গাড়ি পার্কিং ও মেলা বসায় মানুষের চাপের কারনে ২ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে দেবী দর্শন করতে যেতে হয় ভক্তদের। প্রায় তিনশত বছর ধরে কোন ব্যাতিক্রম ছাড়াই একই ভাবে পূজার আয়োজন হয়ে আসছে পাঁচগাঁওয়ে। ৯ অক্টোবর সর্ববৃহৎ এ পূজা শুরু হয়ে ১২ই অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
এদিকে দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা পালন করতে উপজেলা বিএনপি ৭ অক্টোবর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে উপজেলা মাল্টিপারপাস হল রুমে মতবিনিময় করেছে। উপজেলা জামায়াতে ইসলামী ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে একাদিক বৈঠক করেছে।
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ও রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁও গ্রামে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস (বর্তমান সঞ্জয় দাসের) বাড়িতে পালিত হয়ে আসছে ব্যাতিক্রম এই পূজা। প্রতি বছর পূজার সময় মহিষ বলির পাশাপাশি শত শত পাঁঠা, হাঁস কবুতর বলি দেওয়া হয়।
তাছাড়া দুর্গামার জন্য নগদ টাকা, শাড়ি, গহনা সোনা রৌপ্য অলংকারসহ প্রচুর পরিমাণ দক্ষিণা নিয়ে আসেন পূজার্থীরা। স্থানীয়রা জানান যার অনুমানিক মূল্য অর্ধ কোটি টাকারও বেশী হবে।
জনশ্রুতি আছে পাঁচগাঁও পূজা মণ্ডপের তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জয় দাসের পূর্বপুরুষ সাধক সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার আসামের কামরূপ-কামাক্ষ্যার এক বাড়িতে গিয়ে কুমারী পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চান স্থানীয় লোকজন তাকে একটি মেয়ে দেন। সেখানে তিনি কুমারী পুজা করেন। মহাষ্টমীর দিনে কুমারীকে ভগবতীর জ্ঞানে ছয় ঘণ্টা পূজা করার শেষে প্রণাম করার সময় সর্বানন্দ দাস দেখতে পান, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃশ্য দেখার পর মাকে জিজ্ঞাসা করেন, মা আমার পূজা সুপ্রসন্ন হয়েছে কি? উত্তরে ভগবতী বলেন, হ্যাঁ তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে,আমি তোর পুজায় সন্তুষ্ট হয়েছি । এই বর্ণে তোর গ্রামের বাড়ি পাঁচগাঁও-এর পূজামণ্ডপে আবির্ভূত হয়েছিলাম। সর্বানন্দ দাস বলেন তার প্রমান কি? তখন কুমারী হাতের পাচঁ আংগুলে রক্তের চাপ দেন মাথা থেকে স্বর্নের টিকলী খুলে দিয়ে বলেন তোর বাড়ির বেড়ায় পাঁচ আংগুলের চাপ আছে আর এই টিকলী দিয়ে প্রতি বছর মহাষ্টমী তিথিতে স্নান দিয়ে এখন থেকে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি। পরবর্তী বছর সর্বানন্দ দাস তার নিজ বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে এসে বাড়ির বেড়ায় কুমারী মার কথামত হাতের পাঁচ আংগুলের চাপ দেখতে পান কুমারীর দেওয়া চাপ বেড়ার চাপ হুবহুব মিল পান এরপর শারদীয় দূর্গা পূজার আয়োজন করেন কুমারীর গায়ের সেই লাল বর্ণের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে লাল বর্ণে রঞ্জিত করেন মাতৃমূর্তিকে। একই ভাবে প্রায় ৩০০ বছর ধরে সঞ্জয় দাসের বাড়ির মণ্ডপে ব্যাক্তিগত ভাবে লাল বর্ণে দূর্গার পূজা হচ্ছে।
দুর্গাপূজা মণ্ডপকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন পরিষদের ভিতর ও মন্ডপের আশেপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৬ শতাধিক দোকানীরা জামা-কাপড় তৈরি, ও কেনা-কাটা বই, ফার্নিচার, খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি, খেলনা বিভিন্ন রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রাজনগর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রীপদ বৈদ্য হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক টিংকু পুরকায়স্থ জানান প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়াও সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সার্বক্ষনিক সাহায্য সহযোগিতায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় উৎসব মুখর পরিবেশে পালন হবে এবারের শারদীয় দুর্গাপূজা
উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভসপতি অসিত দেব বলেন উপজেলা বিএনপি জামায়াতে ইসলামী আমাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন আমাদের আসস্থ করেছেন এবার অধিকতর আনন্দ উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন হবে।
হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দেব বলেন, শুভ শারদীয় দুর্গাপুজা উপলক্ষে সামগ্রীক নিরাপত্তা অত্যন্ত লক্ষনীয়,আমরা অন্তবর্তী সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানাই।সকল জাতি গোষ্টি সম্প্রদায়ের সহযোগিতা আন্তরিকতায় আমরা অভিভুত। এভাবে সর্বদা একে অন্যে পারস্পরিক ভাতৃত্বের মাধ্যমে একটি কল্যান মুলক সুশাসনের প্রতিস্টা লাভ করুক। গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যা এ জাতি সর্বদাই কামনা করে। দুর্বৃত্ত কোন জাতির নয় সমাজের নয় গোটা দেশের জন্য ক্ষতির কারন।হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের আনন্দমুখর পরিবেশে উদযাপিত হোক শারদীয়া দুর্গাপূজা। রাজনগর থানা অফিসার ইনচার্জ শাহ মোহাম্মদ মোবাশ্বির হোসেন বলেন পূজায় প্রত্যেক মণ্ডপে নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। টহলে থাকবে সেনাবাহিনী, র্যাব ও বিজেপি। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চালু রাখার জন্য পল্লী বিদুৎ অফিসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা জানান, ‘এবারের দুর্গা পূজায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ মন্ডপে সিসি ক্যামেরার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরো জানান সরকারি ভাবে ৭৫ টি সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে ৫শ’ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন