শ্রীমঙ্গলে ‘ক্যাপসিকাম’ চাষে স্বাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন রায়হান আহমেদ
এহসান বিন মুজাহির॥ শ্রীমঙ্গলে প্রথমবারের মতো বিদেশী সবজি ক্যাপসিকাম ও স্কোয়াশ চাষে সফল হয়েছেন এসএসসি পাশ তরুণ রায়হান আহমেদ।
২০১৭ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের হাজী আব্দুল গফুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে রায়হান আহমদ
এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে মতিগঞ্জস্থ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার পর করোনাকাল শুরু হয়। এরপর থেকে রায়হানের পরিবারে নেমে আসে আর্থিক চাপ। পড়ালেখার খরচসহ পরিবারের দায়দায়িত্ব রায়হানের কাঁধে আসে। এরপর তিনি পড়ালেখা বাদ দিয়ে ইউটিউব দেখে ক্যাপসিকামের চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন।অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দূর করতে এরপর শুরু করেন ক্যাপসিকাম চাষ। কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনি চাষে সফল হয়ে সবজি বিক্রি করে লাভবান হতে শুরু করেন। এখন ব্যাপক পরিসরে চাষ করে স্বাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন তার। রায়হানের পিতার নাম গিয়াস উদ্দিন, মাতার নাম নাসরিন বেগম। তার তিন ভাই ১ বোন। বিদেশি সবজির পাশাপাশি রায়হান অন্যান্য সবজির চাষও করেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামের কৃষক মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে রায়হান আহমদ
ইতোমধ্যে ক্ষেতের সবজি বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। আগামীতে আরও ব্যাপক চাষ ও সবজি বিক্রি করে স্বাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই তরুণ।
বৃহস্পতিবার ৭ ডিসেম্বর দুপুরে সরজমিন খলিলুলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকের পাঁচ শতক জমিতে এখন ৫৫০টি ‘সুইট বিউটি’ জাতের ক্যাপসিকাম গাছ রয়েছে। প্রায় দুই ফুট উচ্চতার প্রতিটি গাছেই ৭ থেকে ১০টি সবুজ ক্যাপসিকাম ঝুলছে। চাষি রায়হান আহমদ একুশে সংবাদ ডটকম-কে জানান, ইউটিউব দেখে বিদেশি সবজি চাষের উদ্যোগ নেন তিনি।
শ্রীমঙ্গলে প্রথমবারের মতো লালতির কোম্পানী থেকে ২ পেকেট বিজ সংগ্রহ করে শ্রীমঙ্গল কৃষি অফিসের সহায়তায় ক্যাপসিকাম ও স্কোয়াশ চাষ করছেন এই তরুণ। ক্যাপসিক্যাম ক্ষেতে আসা দর্শনার্থী কবির হোসেন বলেন, নতুন একটি ফল চাষ হয়েছে শুনে এখানে এসেছি। এ ফল আগে আমরা কোনোদিন দেখিনি। বিদেশি এ ফল আমাদের শ্রীমঙ্গলে চাষ হচ্ছে, দেখে খবই ভালো লাগছে।
২৩ বছরের তরুণ রায়হান আহমেদ জানান, পাঁচ শতক জমিতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাপসিকামের বীজ রোপণ করেন তিনি। মাত্র ১০ দিনের মাথায় বীজ থেকে চারা বের হয়ে আসে। কৃষি অফিস থেকে বিনামুল্যে বীজ ও সার পেয়েছেন তিনি। তাছাড়া কৃষি অফিস থেকে নিয়মিত পরামর্শও পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। ক্যাপসিকাম চাষের জন্য বাঁশ, পলিথিন ও নেট দিয়ে রায়হান একটি শেড নির্মান করেছেন। এই শেডের চারদিকে নেট, উপরে পলিথিন ও সিমেন্টের পিলার ব্যবহার করেছেন।
যুবক রায়হান আরও বলেন, সবজি চাষ করতে বাঁশ, নেট, পলিথিন, শ্রমিক খরচসহ বাগান গড়ে তুলতে আমার মোট খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। ক্ষেতে প্রচুর ফলন হয়েছে। এ পর্যন্ত আমি দুই ধাপে বাজারে ২০০ টাকা কেজি দরে ক্যাপসিকাম বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। আশা করছি আগামী এক বছর পর্যন্ত ক্ষেত থেকে ক্যাপসিকাম উত্তোলন করতে আরও দুই লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবো।
কৃষক রায়হান জানান, বিষমুক্ত এ ক্যাপসিকাম চাষে পোকা-মাকড় থেকে রক্ষার জন্য হলুদ ট্র্যাপ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে জৈবসার। ঝড়-বৃষ্টি, পোকা-মাকড় ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য নেট, পলিথিন দিয়ে এমন শেষ তৈরি করা হয়েছে।
কৃষিবিদরা বলেন, ক্যাপসিকাম এ দেশে সবার কাছে মিষ্টিমরিচ নামে পরিচিত। এ মরিচের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সাধারণত এর ফল গোলাকার ও ত্বক পুরু হয়। ক্যাপসিকাম সবুজ, লাল, হলুদ, ও বেগুনি রঙের হয়ে থাকে। এ মরিচ ঝাল নয়, আবার চিনির মতো মিষ্টিও নয়। মরিচের ঘ্রাণ আছে। তাই সালাদের জন্য এ মরিচ খুবই উপযুক্ত। ক্যাপসিকামে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও জিংক রয়েছে। এর কাঁচা ফল সালাদ হিসেবে খুবই মুখরোচক ও পুষ্টিকর। তাছাড়া ক্যাপসিকাম রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি ক্যাপসিকাম দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
শ্রীমঙ্গল কৃষি অধিদপ্তরের জামসী ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুকুর রহমান জানান, ‘মসলার উন্নতজাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারন প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের মাধ্যমে খলিলপুর গ্রামে ক্যাপসিকামে চাষে সফল হয়েছেন তরুণ রায়হান। শ্রীমঙ্গলের মাটি, আবহাওয়া, জলবায়ু সবকিছুই ক্যাপসিকাম চাষের উপযোগী। তাই কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আরো প্রদর্শণী প্লট স্থাপনের মাধ্যমে ক্যাপসিকাম চাষ বাড়াতে আমরা কাজ করছি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন জানান, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের এ ফসল চাষ করে স্বল্প সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছেন রায়হান আহমদ। বেকার ও অলস সময় অতিবাহিত না করে যাদের সামান্য জমি আছে, তাতে ক্যাপসিকামসহ বিভিন্ন লাভজনক সবজি আবাদ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন, এতে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের একটি ফসল। এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে এ ফসল চাষ করে সাফল্য লাভ করা যাবে। চাষীদের উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বাজারে দাম ও চাহিদা ভালো হওয়ায় এ উপজেলায় আগামীতে ক্যাপসিকামের চাষ আরো বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
মন্তব্য করুন