হাকালুকিতে পচা বোরো ধানের দুর্গন্ধ ॥ মরচে মাছ
ইমাদ উদ দীন॥ মরা পচা মাছ আর ধান পচা দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে হাকালুকির বাতাস। গেল ক’দিন থেকে হাকালুকি হাওরে দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠছে। টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর এখন মড়ক লেগেছে মাছে। হওরের বিল এলাকায় হেক্টরের পর হেক্টর পানিতে তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান পচে পানি দূষিত হওয়ায় মরছে মাছ ও অনান্য জলজ প্রাণী। এমনটিই ধারনা স্থানীয় লোকজন ও মৎস্য বিভাগের। পচা ধান আর মরা পচা মাছের দুর্গন্ধে হাওর পাড়ের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ধানের পর মাছ। হঠাৎ একের পর এক দূর্যোগে দিশেহারা হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎজীবী লোকজন। তাদের চোখের সামনেই বছর জুড়ে জীবীকা র্নিবাহের উপকরণ গুলো অকাল বন্যায় গিলে খাচ্ছে। বেঁচে থাকার এই দু উপকরণ হারিয়ে এখন তারা নির্বাক। স্থানীয়রা জানালেন এ ক’দিন থেকে পানির নিছে থাকা ধান পচার কারনে হাওরের পানির রং পরিবর্তন হয়েছে। হাওরের সফেদ পানি রং পরিবর্তন হয়ে এখন কালছে হয়েছে। আর ঘনত্ব বেড়ে ভারি হয়েছে পানি। এতে ব্যাপক হারে মরছে মাছ। মরছে জলজ প্রাণীও। ধান আর মাছ পচা র্দুগন্ধ পুরো হাওর জুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে চরম দূর্ভোগে পড়েছেন হাওর তীরের বাসিন্ধারা। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রয়োজনীয় পানির দেখা দিয়েছে সংকট। হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়ার ভূকশিমইল ইউনিয়নের বড়ধল,কাড়েরা ও ছকাপন এলাকার লাল মিয়া,আছর উল্লাহ,ইসুব আলী, রজব আলী, আমীর আলী, ফুরকান মিয়া, সুরমান মিয়া,অবিন মালাকারসহ অনেকেই জানান। গেল ৩-৪ দিন থেকে হাওরের দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে বমি আসে। মাছ আর ধান পচা দুর্গন্ধে হাওরপাড়ে বসবাস করাই এখন কষ্ঠকর। একই অবস্থা জানালেন একই উপজেলার ভাটেরা,বরমচাল ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের হাওরপাড়ের বাসিন্ধারা। দুর্গন্ধে দূর্ভোগে পড়েছেন জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার হাওর তীরের লোকজন। সরেজমিন হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চকিয়া বিলসহ নৌকাযোগে আশপাশের কয়েকটি বিলে গেলে মরা মাছ পচে ভেসে উঠার দৃশ্য দেখা যায়। ভেসে উঠা মরা মাছের মধ্যে ছিলো পুটি, টেংরা, ভেদা, গুতুম,কাশখয়রা,বাইলা, কাখলা, বাইম, মলা, চাপিলা লাটি,শউল,বোয়াল,চান্দা,পাবদা,রুই,কাতলাসহ নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা মরে ভেসে উঠছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর কুলাউড়ায় হাওরের ১২টি বিলে গড়ে ৯৫০ মেট্রিক টন, বড়লেখায় ১৩৪টি বিলে ৩ হাজার ২৭০ মেট্রিক টন এবং জুড়ীতে ৩৮টি বিলে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এবছর হঠাৎ এমন মড়কে মাছের উৎপাদন নিয়ে বিল ইজারাদার ও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
তবে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন পানির এই সমস্যা কাটিয়ে উঠলে প্রতিবছরের মত এবারো বরাদ্ধকৃত মাছের পোনা অবমুক্ত করা হলে এই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে বলে তারা আশা করছেন। হাওর তীরের ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এখানে ২-৪ বছরের ব্যবধানে পাহাড়ী ঢলে অকাল বন্যা হয়। কিন্তু এবারের মত চৈত্র মাসে কখনও বন্যা হয়নি। এই অকাল বন্যায় ধানের পচনে মাছেও মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজন্ন কেন্দ্রটিতে মৎস্য প্রজনন হুমকির মুখে পড়বে। সংকট সৃষ্টি হবে মাছের। এমনিতে নেই ধান আর সেই সাথে যদি মাছও না থাকে তাহলে হাওর তীরের মানুষের জীবন জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। দক্ষিণ হাকালুকি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির লোকজন জানান, চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় হেক্টরের পর হেক্টর জমির বোরো ধানের পাশাপাশি হাকালুকি হাওরের ছোটবড় ২৩৭টি বিলের অধিকাংশই তলিয়ে যায়। জলমহালগুলো ছেড়ে পোনা মাছ নির্দিষ্ট সময়ের আগে পুরো হাওরেই ছড়িয়ে পড়ে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে। এতে পানি দুষিত হয়ে ব্যাপকহারে মাছে মড়ক লেগেছে। হাওরের চকিয়া বিলে ৩ বছরের জন্য ইজারা নেয়ায় ইজারাদার সেখানে ১৫ লাখ টাকার পোনা মাছ অবমুক্ত করেন। কিন্তু মাছের মড়কে তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবেন বলে জানান। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ.ক.ম শফিক উজ-জামান জানান পানির নিচে থাকা পচা বোরো ধানের কারনে পানির দূষিত হলে শনিবার থেকে মাছের মড়ক দেখা দেয়। খবর পেয়ে আমরা হাওরের বিল গুলো পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে জানাই। সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিন উপজেলা কুলাউড়া,জুড়ী ও বড়লেখার হাওর এলাকায় পানি দূষণমুক্ত করার জন্য ৩ লক্ষ টাকার চুন বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এখন সে গুলো ছিটানোর পাশাপাশি ভেসে থাকা পচা মাছগুলো পানি থেকে সরানোর কাজ চলছে। ৩দিনের জন্য হাওরে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্দ্যোগে স্থানীয় মৎজীবীদের সহযোগীতা করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে ২-১ দিনের মধ্যে দূষনমুক্ত হয়ে পানির গুনগত মান ঠিক থাকবে। সে লক্ষেই আমাদের দ্রুত কাজ চলছে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপন করা সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য করুন