১৪ জুন কমলগঞ্জের মাগুরছড়া ট্রাজেডি দিবস ১৯ বছরেও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি

June 13, 2016,

প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ/সাইফুল ইসলাম॥ আবার ফিরে এসেছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জবাসীর ভয়াল স্মৃতির দিন মাগুরছড়া ট্রাজেডির ১৯তম বার্ষিকী। ১৪ জুন আসলেই মৌলভীবাজার জেলাবাসীকে মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল স্মৃতির কথা। সেদিন মানুষের মন কত ভীত ছিল। কখন এসে আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাস করে ফেলবে। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে ছিল গোটা কমলগঞ্জ।

mugurchare-pic-2-moulvibazaআগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্থ লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটে ছিল দিগি¦দিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেষ্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। দেড় যুগ পার হলেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ।
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্য মতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি। ফিরে আসেনি এখনো প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে।

mugurchare-pic-3-moulvibazaশেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ১৯ বছরে ও ক্ষতিগ্রস্থদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ১৯তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নীরবে চোখের জল ফেলছে। এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনো পুকুরের মতো ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকান্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারী মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলণকারী কোম্পানী অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্ল¬¬কের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্য রাতে ঘটে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ। এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিঃমিঃ (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ টি চাবাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। গ্যাস বিস্ফোরনের পর অক্সিডেন্টাল তাদের সহোদর ইউনোকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি-ঘর, পান জুম এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনোকল। অন্যদিকে দূর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল সড়ক ধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতি পূরণ বাবত বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপুরন দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবত কোন ক্ষতিপূরণ করা হয়নি এবং কোন সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান এর মতে, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তা বুঝতে পারছি। বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয়।
এ ব্যাপারে আলাপকালে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান সোমবার সন্ধ্যায় এ প্রতিনিধিকে জানান, আমার কাছে ক্ষতিপূরণের কোন আবেদন অপেক্ষমান নেই। যেগুলো এসেছিল তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ক্ষতিপূরণের জন্য কেউ আমার কাছে কেউ আসেনি।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ১৯ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৪ জুন মঙ্গলবার কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ এর উদ্যোগে সকাল ১০টায় কমলগঞ্জ উপজেলা চৌমুহনা চত্বরে মাগুরছড়া গ্যাস বিষ্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবীতে এক মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসুচী পালিত হবে। এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালন করবে।
মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট কলামিষ্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া ব্লে¬া-আউটে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আমারা ১০ দফা দাবীতে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। মাগুরছড়া ব্লে¬া-আউটে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবীতে ১৪ জুন সকাল ১০টায় শ্রীমঙ্গল চৌমুহনাতে মানববন্ধন সমাবেশ শেষে শ্রীমঙ্গলের ইউএনওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com