আদিবাসী খাসিয়ারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বড়লেখায় ৭ দিনেও দখলমুক্ত হয়নি পানজুম, গ্রেফতার ২

June 3, 2021,

আব্দুর রব॥ বড়লেখার বনাখলাপুঞ্জির পানজুম দখলের পর ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় জড়িত দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার রাতে ওসি (তদন্ত) রতন দেবনাথের নেতৃত্বে একদল পুলিশ উপজেলার উত্তর ডিমাই গ্রামে অভিযান চালিয়ে মুখলেছ আলী (৪০) ও মহরম আলী ওরফে কুটুন মিয়াকে (২২) গ্রেফতার করেছে। বৃহ¯পতিবার ৩ জুন বিকেলে পুলিশ তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করেছে।
এদিকে ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও ৩ জুন বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বনাখলা পানজুম দখলমুক্ত হয়নি। ইউএনও দখলদারদের সরে যাওয়ার জন্য ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিলেও তারা তাতে কর্নপাত করেনি। এতে ভয়ে জুমে প্রবেশ করতে পারছে না খাসিয়ারা। জুম থেকে পান তুলতে না পেরে তারা মানবেতন জীবন যাপন করছেন।
শুক্রবার বনাখলাপুঞ্জির জুম দখল করে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি। জুম দখলের পর সেখানে তারা একটি ঘরও নির্মাণ করেছে। একসপ্তাহের মধ্যে তাদের দাবিকৃত টাকা না দিলে খাসিয়াদের তারা জুমে প্রবেশ করতে দেবে না। এই ঘটনায় রোববার পুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার ও ছোটলেখা বাগানের প্রধান টিলা করণিক দেওয়ান মাসুদ থানায় পৃথকভাবে দুটি মামলা করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, তারা দখল হওয়া বনাখলাপুঞ্জির পানজুম আইনি প্রক্রিয়ায় দখলমুক্তের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া আগারপুঞ্জির খাসিয়াদের সহস্রাধিক পানগাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বেরা করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আদিবাসী নেতারা। তারা দ্রুত জুম দখলমুক্ত করে খাসিয়াদের বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, উপজেলার ছোটলেখা চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা চাষের জন্য ১ হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫০ একর টিলাভূমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়। পরে তারা ২৭২ একর জমি খাসিয়াদের কাছে উপ-ইজারা দেয়। ২০০৭ সালে খাসিয়ারা ওই জমিতে বনাখলাপুঞ্জি নামে বসতি স্থাপন ও পান চাষ শুরু করেন। পুঞ্জিতে বর্তমানে প্রায় ৩৬টি খাসিয়া পরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য বসবাসরত। প্রতিটি পরিবারের আলাদা পানের জুম আছে। ২৮ মে বোবারথল এলাকার আব্দুল বাছিত, পিচ্চি আমির, লেছই মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে পুঞ্জিতে ঢুকে তিনটি পানজুম দখল করে সেখানে একটি অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে। তখন জুমে থাকা খাসিয়াদের তারা তাড়িয়ে দিয়ে বলে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে ১০ লাখ চাঁদা না দিলে তারা জুমে প্রবেশ করতে দিবে না। এ ঘটনায় ৩০ মে পুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার ও ছোটলেখা বাগানের প্রধান টিলা করণিক মো. দেওয়ান মাসুদ থানায় পৃথকভাবে দুটি মামলা করেন। অন্যদিকে রোববার রাতে একই বাগানের আওতাধীন আগারপুঞ্জির খাসিয়াদের সহস্রাধিক পানগাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ৩১ মে পুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) সুখমন আমসে থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
১ জুন বিকেলে পুঞ্জির ৩৬টি খাসিয়া পরিবারের লোকজন জড়ো হন ছোটলেখা চা-বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোর সামনে। এখানে তাদের সাথে কথা বলেন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) সাদেক কাউসার দস্তগীর। তিনি দ্রুত তাদের জুম উদ্ধার ও দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। এসময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূসরাত লায়লা নীরা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রতন দেবনাথ, দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বনাখলাপুঞ্জির নারী মান্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) নরা ধার জানান, আমরা নিরীহ মানুষ। পানচাষই আমাদের একমাত্র পেশা। পানচাষ করে সংসার চালাই। কিন্তু স্থানীয় সন্ত্রাসীরা আমাদের পানজুম দখল করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। তারা আমাদের হুমকিÑদমকি দিয়ে বলেছে টাকা না দিলে তারা জুম ছাড়বে না।
ছোটলেখা চা বাগানের ব্যবস্থাপক শাকিল আহমদ জানান, খাসিয়ারা আমাদের কাছ থেকে টিলাভূমি উপ-ইজারা নিয়ে পান চাষ করছে। তাদের পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনায় আমরা থানায় মামলা করেছি। বাগান কর্তৃপক্ষ খাসিয়াদের পাশে রয়েছেন।
এদিকে পানজুম দখল ও পুঞ্জির সহস্রাধিক পানগাছ কেটে ফেলার ঘটনায় মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ডাড্লী ডেরিক প্রেন্টিস, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসি ফোরামের মহাসচিব ফিলা পতমী, বাসদ মৌলভীবাজার জেলা শাখা সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবুল হাসান বনাখলাপুঞ্জি ও আগারপুঞ্জি পরিদর্শন করেছেন। তারা পুঞ্জি দুটিতে ঘুরে মন্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ডাড্লী ডেরিক প্রেন্টিস বলেন, খাসিয়াদের পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনাগুলো ন্যাক্কারজনক ও দুঃখজনক। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। একই সাথে আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার যেন আশু সমাধান করেন। খাসিয়া সম্প্রদায় যেন নিরাপত্তায়, নির্বঘ্নে পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, আদিবাসি খাসিয়ারা শুধু পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে না তারা পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একেকটা গাছ তারা সন্তানের মতো বড় করে। এরপর তারা সেই গাছে পান চাষ করে গাছ রক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
বৃহত্তর সিলেট আদিবাসি ফোরামের মহাসচিব ফিলা পতমী বলেন, গত ৩-৪ মাস ধরে সিরিজ সব ঘটনা খাসি জনগোষ্ঠির ওপরে হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন শুধু আমরাই কেন টার্গেট হচ্ছি? কুলাউড়ায় অনেক ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় সিরিজ ঘটনা ঘটছে। আমি প্রশাসনকে বলতে চাই এই ঘটনাগুলোর যদি সুষ্ঠু বিচার না হয় আমরা সকল সংগঠন একসাথে আন্দোলনে যাবো।
বড়লেখা থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বৃহস্পতিবার জানান, দখলদারদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে স্থানীয় চেয়ারম্যান সময় নিয়েছিলেন। তিনি তাদের সরাতে পারেননি। এখন আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের উচ্ছেদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই ঘটনায় দখলদারদের দু’জনকে গ্রেফতার করেছেন। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। খাসিয়াদের সর্বাত্মক আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আগারপুঞ্জি পুঞ্জির পানগাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। জড়িতদের খুঁজে বেরা করার চেষ্টা চলছে।
ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী জানান, বনাখলাপুঞ্জি পানজুম গত কয়েকদিন ধরে দখল করে রেখেছে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি। বিষয়টি জানার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) এবং বড়লেখা থানার ওসিসহ সেখানে গিয়ে খাসিয়াদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাশাপাশি মঙ্গলবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে দখলদারদের সরে যেতে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সরেনি। বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও এসপি মহোদয়কে অবগত করা হয়েছে। পানজুম দখলমুক্ত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com