শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাদ্যযন্ত্র কারিগররা

স্টাফ রিপোর্টার॥ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দরজায় কড়া নাড়ছে প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। কয়েকদিন পরের মৌলভীবাজার জেলায় মন্ডপে মন্ডপে বাদ্যযন্ত্র, ঢাক-ঢোলের শব্দ আর ধূপের গন্ধে মেতে উঠবেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
দুর্গা পূজাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলায় বাদ্যযন্ত্র কারিগররা। এক সময় অনেক ইউনিয়নে ঢাক-ঢোলের কারিগররা বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকলেও এখন আর সেই ব্যস্ততা পরীক্ষিত হয় না। তাদের উত্তরসূরীরা সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে নিয়েছে পূর্ব পুরুষের পেশা। কিছু কারিগর তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পূর্ব পুরুষের পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন আর ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পূজা-পার্বনে এখনও ঢাক-ঢোলের কদর রয়েছে। পূজার আরতিতে ঢোলের কোনো বিকল্প নেই। তাই বছরের একটি সময় ব্যস্ত সময় পার করেন ঢুলি থেকে শুরু করে ঢোল-খোলের কারিগররা। পূজা ছাড়াও বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের আসরে ঢাক-ঢোল অন্যতম বাদ্যযন্ত্র।
কাঠের খুটখাট শব্দে মুখর বাড়ির উঠান।ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত বেশিরভাগ কারিগররা।
ঢাক-ঢোল তৈরির শ্রীমঙ্গলে কারিগর নিত্য বাদ্যকর জানান, পূজাতে ঢাক-ঢোলের বাজনা অপরিহার্য। কারণ হিন্দুশাস্ত্রেও এর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তাই ঢাক-ঢোল ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায় না। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা কমে যাচ্ছে। কাঠ, চামড়াসহ ঢাক-ঢোল তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ হয় না। আগের দিনের মতো ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাক-ঢোল, খোল, তবলা। তবে পূজা উপলক্ষে ঢাক-ঢোলের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তিন পুরুষ ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। অনেক কষ্ট করে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরে রেখেছি ।
একাধিক কারিগর জানান, বছরে তিন (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ) মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। দুর্গাপূজার জন্য কিছু কাজ করছি। এ ব্যবসায় এখন যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করা কষ্টসাধ্য যায়।
বড় আকারের প্রতিটি ঢাক ১০-১৫ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি ৭-৮ হাজার টাকা। ঢোল বড়টি ৬ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি ৫-৬ হাজার টাকা। খোল প্রতিটি ৫ হাজার টাকা। এই কাজ করে এখন সংসার চালানো যায় না। গান বাজনা, যাত্রানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কম হওয়ায় ঢোলের চাহিদাও কমে যাচ্ছে দিন দিন। তাই সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কারিগররা।
আমাদের প্রায় সবারই পূজার সানাইয়ে মন কেমন করে ওঠে। শুধু সানাই নয়, জোড়া কাঠিতে ঢাক কিংবা কাসরের উপর একটানা একটি কাঠির তিনটি শব্দ-সুরের যে মুর্ছনা সৃষ্টি করে এসেছে তা বাঙালির একান্ত নিজের সুর। এ সুরের ইন্দ্রজাল ছিড়ে আমাদের বাঙালির গানে প্রবেশ করেছে গিটার, প্যাডড্রাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। এর প্রভাবে আমাদের ঢাক-ঢোল লালিত সঙ্গীতে পড়েছে নেতিবাচক ছায়া। একথা অবশ্য সত্য যে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং প্রবাহমান। ফলে নতুন বাদ্যযন্ত্র আমাদের সঙ্গীতে স্থান করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে একথাও সত্য যে, আমাদের দেশজ যন্ত্রে সুর ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসার অন্যতম কারণ হলো, এগুলো সঠিকভাবে বাজানো এবং সঠিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তৈরি করা লোকের অভাব। তাই ঢাক-ঢোল মিশ্রিত সঙ্গীতের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হলেও একদিন সত্যিই স্থিমিত হয়ে যাবে আমাদের দেশজ বাদ্যযন্ত্রের সুর।
মন্তব্য করুন