তরুণদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণ এবং নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ জঙ্গিবাদ দমনের প্রকৃষ্ট উপায়
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে সমানতালে। জনসংখ্যা ঠিকই বাড়ছে, কমছে ভাল মানুষের সংখ্যা। আইন কঠোর হচ্ছে। নতুন নতুন আইন হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও বাড়ছে কিন্তু সে অনুপাতে কমছেনা অপরাধ প্রবণতা। মানুষকে মানুষ হিসেবে জ্ঞান করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কারনে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জঙ্গিরা ইসলামের কেউ নয়, এরা বিপথগামী, এরা মানবতাবাদী বিরোধী। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক উগ্রতা ও তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় দেশ ও সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের নামে এ সমস্ত বিপথগামী তরুণদের কেউ মাদ্রাসার ছাত্র, কেউ কলেজের আবার কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সকল শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ রোধ করা সম্ভব হবে। এ কাজটি শুরু করতে হবে একেবারে প্রাইমারী স্কুল থেকেই। প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট ২০১৫ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দেশের ২৩ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। ৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। ৪১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য বার্ষিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা নাই। ৪৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হয় না। শিক্ষার্থীরা স্কাউটিং এর সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও সংখ্যা ৭০ শতাংশ। মহান জাতীয় সংসদে গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে সর্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তারা কোথায় যায়, কী করে এগুলোর উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। যারা ইসলামের নামে নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালায় তারাই জঙ্গি নামে পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর জঙ্গি হওয়ার পিছনে কিছু সংখ্যক শিক্ষকদের সহযোগিতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিছু শিক্ষক সরাসরি জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত বলেও জানতে পেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউ জি সি) একটি তদন্ত দল। এ সংবাদ দেশবাসীর জন্য উদ্বেগজনক। যে শিক্ষকদের উপর আস্থা ও ভরসা রেখে অভিভাবকরা সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য পাঠান সেই শিক্ষকই যদি শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বানিয়ে দেয় তাহলে এর চেয়ে জাতির কাছে আর কি দুর্ভাগ্য হতে পারে। এরা শিক্ষক নয়, এরা শিক্ষক নামের কলংক। এ সমস্ত জঙ্গি শিক্ষকদের তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্য কোনো শিক্ষক জঙ্গি হতে বা জঙ্গি কার্যক্রমে সহায়তা করতে সাহস পাবে না। এদের বিচার করতে বিলম্ব করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’। জঙ্গিবাদ দমন করতে হলে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। প্রাইমারী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নৈতিকতার উপর একটি ক্লাস রাখা যেতে পারে। নৈতিক মানসম্পন্ন শিক্ষক সেই ক্লাসে বক্তব্য দিবেন। টেলিভিশনগুলোতে শিশু কিশোরদের মন ও মননশীলতার উৎকর্ষতার জন্য নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে।
তরুণ শিক্ষার্থীদের নানামুখী সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের মধ্যে জড়িত রেখে তাদেরকে সব সময় যাতে আনন্দদায়ক পরিবেশে রাখা যায় সে উদ্যোগ গ্রহণ করলে জঙ্গি দমনে সহায়ক হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনোদনের সুযোগ বাড়াতে হবে, খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। নৈতিকতার একটি পাঠ চালু করাও প্রয়োজন। সভ্যতা, নম্্রতা ও বিনয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের বুঝাতে হবে তাদের মূল পরিচয় মানবতা নির্ভর। অপরের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি যতœশীল ও শ্রদ্ধাশীল থাকার শিক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। ভারসাম্যহীন চিন্তা চেতনার বিকাশ এবং সন্ত্রাসের প্রকাশ রুখতে হলে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ঐক্য ও সমঝোতা নিশ্চিত করতে সকল সচেতন মানুষকেই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদ্যালয়ের পরিবেশ, ছাত্র ও শিক্ষকদের সুসম্পর্ক সহপাঠী ও সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ যাতে সকলের জন্য অনুকরণীয় হয় এজন্য বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে সচেষ্ঠ থাকতে হবে। শিক্ষকরাও যাতে নৈতিক মানসম্পন্ন হয় সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের মধ্যে যদি দৃঢ় নৈতিকতা থাকে তাহলে ঐ নৈতিক মনোবল আজীবনের জন্য ছাত্রদের মধ্যেও স্থাপিত হয়ে যায়। সুতরাং শিক্ষকদের প্রকৃত শিক্ষক হতে হবে। কারণ, শিক্ষকই মানুষকে পশুত্বের জগৎ থেকে মনুষ্যত্বের অমরলোকে উত্তোলন করেন। সকল শিক্ষককে মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের বলা হয় Guardian of civilization, architect of the nation.
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় জঙ্গিবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মানুষে মানুষে মমত্ববোধ ও সহমর্মিতার অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে ওঠা। জঙ্গিবাদ দমনে ও নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে-
সামাজিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীসহ সকল মানুষকে সচেতন করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নৈতিকতা বিষয়ক সেমিনার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অন্যের দুঃখকষ্টে মানুষকে তাদের বিপদাপদে পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
অপসংস্কৃতির কুফল তুলে ধরে নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা ও চর্চা করার জন্য সচেষ্ঠ হতে হবে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা বিষয়ক কোর্স বাধ্যতামূলক করা যায় কিনা বিবেচনা করা যেতে পারে।
পৃথিবী বিখ্যাত বড় বড় মনীষীদের জীবনী ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকেই অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম ও সামাজিক সংগঠনে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। পাঠ্য বইয়ের বাহিরে ভাল মানের বই পড়ার অভ্যাস করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালামের একটি মহামূল্যবান উক্তি সকলের জন্যই প্রাসঙ্গিক। উক্তিটি হলো-“একটি বই ১০০টি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভাল বন্ধু পুরো একটি গ্রন্থাগারের সমান।”
একজন শিক্ষার্থীকে যদি তার ছেলেবেলা থেকেই নৈতিক মানসম্পন্ন ও এক মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলেই নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করে একটি দায়বদ্ধ সমাজ ও রাস্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব। এটি করা সম্ভব হলে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে মানুষ দুটি শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। সেগুলো হলো বৈষয়িক শক্তি ও নৈতিক শক্তি। বৈষয়িক শক্তির উৎকর্ষের প্রতীক হলো দক্ষতা আর নৈতিক শক্তির উৎকর্ষের প্রতীক হলো সততা। মানুষের জন্য দুটি গুনই দরকার। তবে বেশী দরকার হলো সততা। এ গুনটি থাকলে দক্ষতা আপনা আপনিই চলে আসে। মানুষ তার জ্ঞান দ্বারা মানসিক শক্তির অধিকারী হয়। পাশাপাশি নৈতিক গুন দিয়ে মানুষ পশুশক্তিকে পরাজিত করে। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করতে মানুষকে নৈতিক গুণের অধিকারী হতে হবে।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সরকারের একার নয়। এ লড়াই সফল করতে হলে পুরো সমাজ বিশেষ করে তরুণদের আরও বেশী করে যুক্ত করতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে কিন্তু কাজটি শুধুমাত্র পুলিশের নয়। এ দায়িত্ব সমাজের সবাইকে নিতে হবে।
সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ জন হারগান সন্ত্রাসবাদীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন- তারা বিছিন্নতায় ভোগে, ক্রোধান্বিত থাকে, নিজেদেরকে অধিকার বঞ্চিত মনে করে।
তারা বিশ্বাস করে যে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের পক্ষে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
যাদের জন্য তারা যুদ্ধ করছে সেই জনগোষ্ঠির কোনো সদস্য বা অংশ বিশেষের উপর সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হলে তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে গভীর একাত্বতা অনুভব করে এবং ওইসব সমস্যা নিয়ে কথা বলার চেয়ে সরাসরি এ্যাকশন গ্রহণকে উত্তম মনে করে।
তারা বিশ্বাস করে যে এরকম এ্যাকশন করতে গিয়ে সহিংস হওয়া অনৈতিক কাজ নয়।
তারা বিশ্বাস করে এরকম আন্দোলনে যোগদান করলে সামাজিক, মানসিক ও ধর্মীয়ভাবে পুরস্কৃত হবে অর্থাৎ পরকালে বেহেশত নিশ্চিত হবে।
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝা যায় জঙ্গিবাদ হলো এক ধরণের আসক্তি। মাদকাশক্তির মতোই জঙ্গিবাদে দীক্ষা নেওয়াও এক ধরণের মানসিক ব্যাধি। মাদকাশক্তির মতো যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে তাদের ফিরিয়ে আনতে দরকার বহুমুখী পদক্ষেপ।
গুলশান ট্রাজেডির পর থেকেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে। দলমত ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নারী পুরুষ ও তরুণদের মাঝে সচেতনতা তৈরী হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও সংগঠন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। নিহত জঙ্গিদের লাশগুলো হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। লাশ গ্রহণ করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো মা-বাবা বলেছেন তারা জঙ্গি সন্তানের লাশ নেবেন না, এলাকায় দাফন হোক তাও তারা চান না। জঙ্গিদের প্রতি কতটা ঘৃণা থাকলে এরকম পরিস্থিতি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এতেই বুঝা যায় বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয় যে পর্যায়েই থাক না কেন জঙ্গিবাদকে কেউই সমর্থন করে না বা করবেও না। এই ইতিবাচক পরিস্থিতি বাংলাদেশের শান্তিকামী দেশপ্রেমিক মানুষকে আশাবাদী করে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিরোধকে কাজে লাগাতে হবে।
মন্তব্য করুন