আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা দিবস ২০২২ উপলক্ষে র‌্যালী ও সচেতনতা সভা

June 6, 2022,

শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি॥ শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগানে আর্ন্তজাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা দিবস ২০২২ উপলক্ষ্যে র‌্যালী ও সচেতনতা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
রোববার ৫ জুন উপজেলার রাজঘাট, খেজুরীছড়া ও ফুলছড়া চা বাগানে স্থানীয় বাগান পঞ্চায়েত কমিটির আয়োজনে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। উক্ত কার্যক্রমে সহযোগিতা করেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু বিজয় বোনার্জী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজঘাট চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো: মুমিনুল ইসলাম, সিআইপিআরবি’র সিলেট বিভাগের সমন্বয়কারী আলতাফুর রহমান, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক দুলন চন্দ্র দেব এবং ইউপি সদস্য মো: সেলিম আহমদ। র‌্যালীতে স্থানীয় ক্লাবের সদস্য, পঞ্চায়েত কমিটির নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ দু’শতাধিক চা শ্রমিক নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করেন।
সভায় জানানো হয়, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এর সহযোগিতায় সিআইপিআরবি’র মাধ্যমে সিলেট বিভাগের সকল জেলায় ‘‘ফিস্টুলা নির্মূলকরণ কার্যক্রম-২০৩০’’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় প্রধানতঃ ফিস্টুলা রোগী শনাক্তকরণ, রেফারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং পূনর্বাসনের আওতাভূক্ত করতে সহযোগিতা করা হয়।
সভা সূত্রে জানানো হয় যে, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগের চা বাগানে ৩৪জন রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় মোট ১৫জন রোগী সনাক্ত করা হয়েছে; এর মধ্যে চা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৯জন রোগী ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, চা বাগানগুলোতে অধিক সংখ্যক ফিস্টুলা রোগী থাকতে পারেন। সে জন্য চা বাগান এলাকায় অধিক পরিমাণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে, বাল্য বিবাহ, স্বল্প বয়সে গর্ভধারণ, হাসপাতালে প্রসব করানোর জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমকে আরো জোরদার করতে হবে।
ইউপি চেয়ারম্যান বাবু বিজয় বোনার্জী বলেন, ফিস্টুলা প্রতিরোধের জন্য দূর্গম চা বাগানগুলোতে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বাল্য বিবাহ বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত প্রসব জটিলতায় দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। তিনি রাজঘাট ইউনিয়নকে ফিস্টুলা মুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বয় ও সহযোগিতা কামনা করছেন।
সহকারী ব্যবস্থাপক মো: মুমিনুল ইসলাম বলেন, চা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাগান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাগান কর্তৃপক্ষ সকলের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে ইচ্ছুক।
সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক দুলন চন্দ্র দেব বলেন, সরকারের লক্ষ্য আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফিস্টুলা নির্মূল করা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সহযোগিতা ও সমন্বয় প্রয়োজন হবে। তিনি আরো বলেন, ফিস্টুলা প্রতিরোধের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়াতে হবে।
সিআইপিআরবি’র সমন্বয়কারী আলতাফুর রহমান বলেন, দেশে দিন দিন প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ রোগে আক্রান্ত নারীদের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও অবহেলা এবং অবমাননার শিকার হতে হয়। তাদেরকে সামাজিক ও পারিবারিক বোঝা মনে করেন অনেকে। একজন ফিস্টুলা রোগী যে ধরনের মানসিক বিষন্নতা, উদ্বেগ ও অশান্তি অনুভব করেন সেটা খুবই ভয়াবহ। তিনি আরো বলেন, বিলম্বিত প্রসব বা বাধাগ্রস্ত প্রসব, বাল্যবিবাহ ও কম বয়সে গর্ভধারণ, জরায়ুতে অস্ত্রোপচার, অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করানোসহ সচেতনতার অভাবে ফিস্টুলা রোগ বাড়ছে।
সিআইপিআরবি’র সহায়তায় প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়। এখনো দরিদ্র রোগীদের জন্য চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ এমনকি যাতায়াত খরচও সিআইপিআরবি’র সহায়তায় প্রদান করা হচ্ছে। সহায়তার জন্য ০১৭১২২৩৮৪৯৭ নাম্বারে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
বছর দশেক ধরে রাজঘাটের আকলমনি পট নায়েক ভোগছিলেন ফিস্টুলা রোগে। তার ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর প্রথম বাচ্চা বাড়িতে জন্মের পর মারা যায়। এক বছর পর দ্বিতীয় প্রসবেও বাড়িতে মৃতজন্ম হয়। তারপরের বছর তৃতীয় প্রসবের সময় সারারাত বাধাগ্রস্ত প্রসবে ভোগে স্থানীয় বাগান হাসপাতাল হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আশংকাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়। প্রসব জটিলতার জন্য তাকে সেখান থেকে আবার জেলা সদর হাসপাতাল হয়ে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে পরেরদিন সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে মৃত বাচ্চার প্রসব হয়। ওই সময় তার ফিস্টুলা শুরু হয়।
খেজুরীছড়া বাগানের মালতি রিকিয়াসনকে ১৬ বছর বয়সে বাল্য বিবাহের শিকার হতে হয়। আর এই বাল্যবিবাহ ও ঘনঘন গর্ভধারণই তাকে ফিস্টুলাতে আক্রান্ত হতে সহায়তা করে। বারবার বিলম্বিত প্রসব ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের শিকার হওয়া সত্ত্বেও, ৩ বারই বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দ্বারা মালতির প্রসবের চেষ্টা করা হয়। ৩য় প্রসবের সময় ৪৮ ঘন্টা বাড়িতে বিলম্বিত প্রসব জটিলতায় ভোগার পর তাকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে মৃত বাচ্চার প্রসব হয় এবং তখন থেকে ফিস্টুলায় ভোগতে থাকেন। এমতাবস্থায়, তালাকপ্রাপ্তা হয়ে জীবনে বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।
আকলমনি ও মালতি নারীরা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে আসতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সিআইপিআরবি। এরকম শতাধিক মায়ের জীবন রক্ষার্থে সিলেট বিভাগে অবদান রেখে চলেছে সিআইপিআরবি।
প্রসঙ্গত, নারী জননাঙ্গের ফিস্টুলার লক্ষণ হচ্ছে, রোগীর সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্রাব বা পায়খানার সময় রোগীর কোনো চাপ বা বেগ অনুভব হবে না। সব সময় কাপড় ভেজা থাকবে। এ সমস্যা শুরু হবে সন্তান প্রসবের পর কিংবা তলপেট বা জরায়ুতে কোনো অপারেশনের পর। অর্থাৎ ফিস্টুলা হচ্ছে মাসিকের রাস্তার সঙ্গে মূত্রথলি অথবা মলাশয়ের এক বা একাধিক অস্বাভাবিক ছিদ্র হয়ে যুক্ত হওয়া। ফলে মাসিকের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com