শ্রীমঙ্গলে চা গাছ কাটতে দায়ের পূজা

বিকুল চক্রবর্তী॥ চা গাছে যেন প্রচুর পরিমান কুড়ি আসে এই কামনায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চা গাছের নিচে পূজা দিয়ে ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শুরু হয়েছে চা গাছের প্রুনিং। সোমবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল সাঁতগাও টি এস্টেটের মাকরী ছড়া চা বাগানের ২নং শেকশনে এ পূর্জাচনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে বাগানের শ্রমিকরা। এ সময় বাগানের শ্রমিক ও সরদারদের সাথে উপস্থিত ছিলেন সাঁতগাও চা বাগানের প্রধান ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক আশরাফুল সিদ্দিকি, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল কুদ্দুছ অভি, মাকরী ছড়া টিলা ক্লার্ক সুরঞ্জিত দাশ ও সাতগাও ইউনিয়নের মহিলা সদস্য শোভারাণী কুর্মী।
চা চাষের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত কয়েক ধাপে প্রুনিং করা হয়। এর পর মার্চের মাঝামাঝি গাছে পাতা আসতে শুরু করে। পাতা আসার জন্য বিশেষ কৌশলে নির্দিষ্ট সময়ে এ প্রুনিং করতে হয়। প্রুনিং ঠিক না হলে পাতা ভালো আসেনা। বিশেষ করে গাছের দীর্ঘজীবিতা ও প্রচুর পরিমানে পাতা দেয়া কমে যায়। এই প্রুনিংয়ের জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ শ্রমিক তেমনী প্রুনিংয়ে ব্যবহৃত দায়েও প্রয়োজন বিশেষ ধার। বিষয়টিকে বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শ্রমিকরা অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর প্রুনিং শুরুর আগে বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকরা প্রথমে একটি চা গাছকে লাইট প্রুনিং করে (২২ ইঞ্চি থেকে ২৮ ইঞ্চি রেখে উপরের অংশ কেটে দেয়া) সে গাছের নিচ পরিস্কার করে চা গাছ কাটার দা গুলো গাছের নিচে রেখে ঈশ্বরের নামে নৈবিদ্য অর্পন করা হয়। এর উদ্দেশ্য প্রুনিং যেন ভালো হয় এবং সে গাছে যেন প্রচুর পরিমানে পাতা আসে।
সোমবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল মাকরীছড়া চা বাগানে ২নং শেকশনে একটি চা গাছর নিচে পূর্জাচনা ও পাশেই মিলাদ মাহফিল করে প্রথম গাছ প্রুনিং করেন বাগানের প্রধান সরদার গুরুচরণ সৎনামী। এ সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন বাগানে প্রধান সরদারনী প্রতিমা রানী ও বাগানের ব্যবস্থাপক, সহকারী ব্যবস্থাপক এবং অনান্যরা।
বাগানের প্রধান সরদার গুরুচরণ সৎনামী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কে জানান, গাছের প্রুনিং এর উপর নির্ভর করে বেশি পাতা পাওয়া ও গাছকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা। এটি করতে হয় খুব শর্তক হয়ে। এটি কাটার সময় শ্রমিকদের সাথে বিশেষ পারদর্শী সরদারদের লক্ষ রাখতে হয়। তিনি জানান, এই গাছই তাদের জীবন। চা গাছের পাতায় চলে চা শ্রমিকের সংসার। তাই এই বিশেষ কাজ শরু করার পূর্বে সনাতন ধর্মালম্বী শ্রমিকরা পূর্জাচনা করে এবং ইসলাম ধর্মালম্বী শ্রমিকরা মিলাদ মাহফিল করে কাজ শুরু করে। বাগান ব্যবস্থাপক সবাইকে মিষ্টিমূখ করান।
সাতগাও চা বাগান ব্যবস্থাপক রফিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কে জানান, প্রুনিং ভালো না হলে ভালো ক্রপ আসবে না। এটিকে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। প্রতিবছর পূর্জাচনা ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে তারা তা শুরু করেন। শ্রমিকরা আয়োজন করেন তারা সে খরচ দেন। তিনি জানান, কাজ শুরুর সময় প্রত্যেকে মিষ্ট মুখ করান। তাঁর তিন টি বাগানে এ উপলক্ষে প্রায় শত কেজি মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।
এ ব্যপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিচালক ড. রফিকুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কে জানান, এটিকে চা বোর্ড থেকেও অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎপাদন ঠিক রাখতে তারা এ বিষয়ে বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ও, টিলাক্লাকদের প্রশিক্ষন দিয়ে থাকেন।
প্রুনিং বিষয়ে বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রের চা বিজ্ঞানী ড. মো: তৌফিক আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কে জানান, সঠিক প্রুনিং এর উপর নির্ভর করে গাছের দীর্ঘ জীবিতা। তিনি জানান, এর একটি গ্রামারটিক্যাল সার্কেল রয়েছে। প্রুনিং চার ধরনের। একটি এলপি বা লাইট প্রুনিং, যা গাছ রোপনের ৫ম বছরে করতে হয়। এ সময় গাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী ২২ থেকে ২৮ ইঞ্চি রেখে বাকি টা কেটে দিতে হয়। যার সময় কাল ডিসেম্বর মাস। এর পরের বছর করতে ডি.এস.কে. ডিপ প্রুনিং। এ সময় গাছের উচ্চতা ২৬ থেকে ৩২ ইঞ্চি রেখে পুরোটা কেটে দিতে হয়। এটি জানুয়ারীর মধ্যভাগে শেষ করতে হয়। তৃতীয় বছরে করতে হয় এম.এস.কে. মিডিয়াম প্রুনিং যার প্রুনিং পয়েন্ট ২৮ থেকে ৩৪ ইঞ্চি। এর সময় কাল ১৫ থেকে ৩০ জানুয়ারীর মধ্যে। চতুর্থ বছরে করতে হয় এল. এস. কে. বা লাইট স্ক্রেপ। যা ২৯ থেকে ৩৫ ইঞ্চির মধ্যে কাটতে হয়। তা শেষ করতে হয় ১৫ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে। এর পর পুনরায় এলপি দিয়ে শুরু হবে। তবে গাছ রোপনের প্রথম বছর গাছকে ডি সেন্টারিং করতে হয়। অর্থাৎ গাছের মধ্য ভাগের মুল ডাল টি ৬ থেকে ৯ ইঞ্চি কেটে দিতে হবে।
এ ব্যাপারে চা বিজ্ঞানী শেফালী বুনাজী জানান, একটি পরিমিত বয়সের ১২ থেকে ১৪ বছরের চা গাছে বছরে এক কেজি গ্রীণ লিফ দিবে যা থেকে ২৫ গ্রাম মেইডটি হবে। আর প্রতি হেক্টরে অন্তত ১৫ হাজার চারা রোপন করতে হয়।
মন্তব্য করুন