একজন নিভৃত রঙিন স্বপ্নচারী রঙের ফেরিওয়ালা হিমাদ্রী

November 15, 2020,

তোফায়েল পাপ্পু॥ চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলার অশিদ্রোন ইউনিয়নের রামনগর মণিপুরিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিমাদ্রী লাল ধর। পেশায় শিক্ষকতা হলেও নেশা তার ছবি আাঁকা। চাকুরী ও আটপৌরে জীবনের কঠিন নিয়মের পাশাপাশি যখনই একটু সময় হয়, তখনই রঙ-তুলি নিয়ে আপন ভূবনে ডুবে থাকেন তিনি। ঊষার সূর্য কিংবা গোধূলির রঙ সবটাই যেনো তাকে আপ্লুত করে ওদের শাশ্বত মহিমায়। আর তিনিও যেনো নিবেদনের আবেগে আবেগিত হয়ে ছুটে চলেন প্রতিটি গায়ত্রীসন্ধ্যায় শুদ্ধ মুসাফির হয়ে।

“এখনতো চারদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না” শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের একটি উক্তিকে মনে লালন করেই ছবি আঁকেন হিমাদ্রী। অতি সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে রঙের ফেরিওয়ালা হিমাদ্রী’র হাতে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্মগুলো।

চিত্রাঙ্কন মানুষের জন্মান্তরের নেশা। আদিম মানুষ পশু শিকার করে মনের খেয়ালে গুহার দেয়ালে ছবি এঁকে রাখত। ভ্যান গগ, লিওনার্দে দ্যা ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো থেকে আমাদের জয়নুল আবেদীন, এসএম সুলতানসহ ছবি আঁকা প্রবাহমান নদীর মতোই চলছে। গ্রামীন নদী, নৌকা, গাছ, পশু-পাখি, প্রকৃতি, কৃষক, জেলে, নারী ও দুরন্ত কিশোরের কাজে যেমন সৌন্দর্যের রঙ ছড়িয়ে আছে, তেমনি বিভিন্ন মনীষীদের জীবনবোধের রয়েছে বৈচিত্র্যতা।

এমনই একজন রঙের ফেরিওয়ালা চিত্রশিল্পী হিমাদ্রী শৈশব হতেই অনুভব করতেন প্রকৃতি, পরিবেশ, ছড়া-নদী, বন-পাহাড়, চা বাগান, ইতিহাস-ঐতিহ্যেসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতির ছবি। হিমাদ্রীর হাতের শৈল্পীক ছোঁয়ায় তাই ফোঁটে ওঠেছে অসংখ্য জল রঙ, তেল রঙ, এক্রেলিক রঙ, স্কেচ ও মিশ্র মাধ্যমের চিত্রগুলি।

আমাদের নিত্য দেখা বিষয়কে নতুন উপলব্ধির জায়গায় নিয়ে গিয়ে হিমাদ্রী’র আাঁকা চিত্রকর্মগুলোতে ফোঁটে ওঠেছে নগর জীবনে ব্যস্ত শহরের বাস্তবতার প্রতিকৃতি, সাগর তীরের আছড়ে পড়া ঢেউ, আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা, বৃষ্টির সৌন্দর্য, পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির মমতা, দূর আকাশের মেঘমালা আর মেঘে ঢাকা চন্দ্রালোকের নান্দনিকতার দৃশ্যসমূহ। তার চিত্রে যেমনি ফোঁটে ওঠেছে দিগন্তজোড়া আকাশ, মাটি এবং প্রকৃতির মেলবন্ধন,  নারীর বঞ্চনা কিংবা একাকী জীবনের যাতনা, তেমনি ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে অসাধারণ মেয়েলি চিত্রকর্মে সুন্দরী নারীর মুখশ্রীর সাযুজ্য মধুরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এ যেনো, মনে ভাল লাগার অনুভূতি জাগিয়ে আমাদের চিরচেনা বিষয়গুলোকে হিমাদ্রীর শৈল্পিক উপস্থাপনাগুলো মানুষকে কল্পলোকের জগতে নিয়ে যায় অনায়াসে।

ব্যক্তিগত জীবনে শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের স্টেশন রোডে জন্মগ্রহণ করেন হিমাদ্রী লাল ধর। পিতা হিমাংশু ধর ও মাতা সাধনা ধরের বড় ছেলে তিনি। শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯৮ সালে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ হতে এইচএসসি, ২০০১ সালে সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ হতে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক এবং ২০০২ সালে একই কলেজ হতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকা আর্ট কলেজ হতে চারু ও কারু বিষয়ে বিএফএ (প্রি-ডিগ্রী) পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকুরীর ফাঁকে অবসর সময়ে শ্রীমঙ্গল চারুকলা একাডেমীতে শিক্ষকতা করছেন তিনি।

ছোট বেলা হতেই আঁকাজোখার প্রতি তীব্র আগ্রহ হিমাদ্রীর। বিভিন্ন রঙের ফুল, পাখি, প্রজাপতি, গাছ-গাছালি, গ্রামের প্রকৃতি, মানুষের জীবনধারা, আঁকাবাঁকা নদী, কাছে-দূরের পাহাড়, ঘর-বাড়ি, দেশ-বিদেশের অদ্ভুত সৌন্দর্য্যগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করে মনের মাধুরী মিলিয়ে ফোঁটিয়ে তুলেন তার চিত্রকর্মে। গ্রামের মেঠোপথের রঙের ফেরিওয়ালার মতোই কখনো কল্পনায়, কখনো কাগজে, কখনো কাপড়ে পেন্সিল কিংবা কলম অথবা রঙ-তুলি হাতে নিয়ে পৃথিবীর রঙ-রূপের রঙিন ছবি কল্পনার ক্যানভ্যাসে এঁকে চলেছেন ঘরে-বাইরে সবখানে।

একজন নিভৃত রঙিন স্বপ্নচারী হিসেবে রঙের ফেরিওয়ালা হিমাদ্রী লাল ধর বলেন, “আমি এক গলিপথের শিল্পী। মেইন সড়কে উঠার দুঃসাহস কখনোই করিনি। শৈশবকাল থেকেই আমার কল্পনার ক্যানভাসে রূপসী বাংলার রঙিন ছবিগুলো মনের মতো করেই এঁকে চলেছি আজ অবধি। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমিও চিত্রিত করি সময়কে। আমাদের সামাজিক অবক্ষয়, মাদক, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি প্রতিরোধে শিল্পচর্চাই হতে পারে কার্যকর হাতিহার। তাছাড়া শিল্পচর্চা মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই- সেই উত্তর দায়িত্ব পালনে কতোটা পথ এগিয়ে এলাম সেটা বড় নয়, বরং আপামর জনসাধারণের সহযাত্রী হয়ে আমার সৃষ্টিকে প্রাণের দোসর করে আগামীর পথে চলবো” চারুকলায় বসে এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেন তিনি।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com