বীরের মৃত্যুবার্ষিক ও শেষ সাক্ষাৎকার

তমাল ফেরদৌস॥ একজন বীরের মৃত্যুবার্ষিক আজ। এজেলার বীর ছিলেন তিনি। বেঁচে থাকতেও বীর ছিলেন, মরে গিয়েও বীর রয়ে গেছেন। তাঁর জায়গা অপূরণীয়।
জানিনা তাঁর মৃত্যুর দিনে দল থেকে কোন কর্মসূচী আছে কি না ?। রাজনীতি, সামাজিকতা বা ক্ষমতার মানদ-ে তাঁর সমকক্ষতো নয়ই-ধারেকাছেও নেই কেউ।
তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে আরেকটি পর্বের সূচনা হয়। শোক প্রস্তাবে বিশ মিনিটের অধিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন, কেঁদেছিলেন। সম্ভবত কোন মন্ত্রীর মৃত্যুতে কোন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ অধিবেশনে কেঁদে স্মরণ করা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেকোন দেশে বিরল।
সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সৈয়দ মহসীন আলী শুধু একজন মন্ত্রীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত প্রাণ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। তিনি জীবদ্দশায় মুক্তিযুদ্ধে, দেশপ্রেমে, রাজনীতিতে, জনপ্রতিনিধিতে ছিলেন একজন বীরের মতো বীর। আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, কিভাবে আমি তাঁর শুণ্যস্থান পূরণ করবো।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন বীর, পৌরসভায় তিনি ছিলেন বীর, সংসদ সদস্যেও তিনি ছিলেন বীর। আর মন্ত্রীত্বে তিনি ছিলেন বীরের বীর। বাংলা, ইংরেজী, হিন্দি, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় তাঁর ছিলো অনর্গল কথা বলার অভ্যাস। তাইতো তিনি সংসদে অনর্গল ইংরেজী ভাষায় কথা বলেছেন, বক্তব্যও দিয়েছেন। তখন অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেছেন তাঁর দিকে। কিন্তু সময় ও নিয়মের কারণে একসময় তাঁর বক্তব্য থামতে হয়েছিলো। হয়তো তিনি আরো দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু সম্ভব হয়নি।
সৈয়দ মহসীন আলী সাংবাদিকদের অতি সজ্জন একজন ব্যক্তি ছিলেন। মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব তাঁর কাছে ঋণী। তিনি প্রেসক্লাবের বর্তমান ভবনের জায়গাটি দান করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রয়াত সাজ্জাদুর রহমান পুতুল সাহেব হস্তান্তর করেছিলেন কাগজপত্র। তবে সৈয়দ মহসীন আলী প্রেসক্লাবকে আজীবন নগদ অর্থ ও অনুদান দিয়ে গেছেন। এজেলার সাংবাদিক বিশেষ করে মৌলভীবাজার সদরের সাংবাদিকরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। সদা সরল এই ব্যক্তিটি হঠাৎ করেই প্রেসক্লাবে এসে বসে সাংবাদিকদের সাথে গল্প-গুজবে মেতে উঠতেন। জেলাসহ জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের বিষয়ে তিনি তথ্যবহুল কথাবার্তা বলতেন। সাংবাদিকদের তথ্যভা-ার সমৃদ্ধ হতো। সাংবাদিকরা তাই তাঁকে এমপি, মন্ত্রী ভাবতো না। ভাবতো একজন সাংবাদিক হিসেবে। তাঁর সাথে তাই এজেলার সাংবাদিকদের একটা নাড়ির বন্ধন জড়িয়ে আছে।
তিনি মন্ত্রী হবার পর অনেক আলোড়ন তোলার খবরের পাশাপাশি একটি বিষয় সারা দেশে খুব আলোড়ন তুলেছিলো। আর সেটা হলো একমাত্র মন্ত্রী তিনি ছিলেন যে যেকোন অনুষ্ঠানে দেশের গান ও আধুনিক গান করতেন নিজের কণ্ঠে। তিনি প্রায়ই বলতেন, গান দিয়ে মানুষের মন যতোটা সহজে জয় করা যায় অন্যকিছুতেই তা হয়না। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে জয়ের ক্ষেত্রে গানের একটা বড় ভূমিকা ছিলো বলে তিনি বলতেন।
মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে ১৬ আগস্ট ২০১৫ তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। তিনি মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে এসেছিলেন বৃক্ষ রোপন করতে। আমাকে দেখেই বলেছিলেন দেখো আমি হাজার হাজার ফলদ, ঔষধি গাছ কিনে রেখেছি। এগুলো সারা জেলার বিভিন্নস্থানে রোপন করা হবে। মানুষ এগুলো থেকে ফল খাবে ও উপকৃত হবে। তিনি সার্কিট হাউসে একটি ভালো জাতের আমের চারা লাগিয়েছিলেন। জেলা শহরের সড়কের মধ্যখানের ডিভাইডারের উপর সযতনে যে বৃক্ষগুলো আজ শহরকে শোভা দিচ্ছে। সেগুলোও তাঁর পরিকল্পনায় লাগানো। এই বৃক্ষগুলো ফুল দিচ্ছে, সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে শহরের কিন্তু এগুলো থাকলেও সৈয়দ মহসীন আলী আজ নেই।
মন্ত্রী হবার পর তিনি যাত্রার গানের টাকায় সৈয়দ শাহ মোস্তফা বোগদাদী (র.) এর ঈদগাহের পশ্চিমদিকের জমি ভরাট করেছিলেন। এই কথাটি যখন তিনি ঈদের জামাতপূর্ব বক্তব্যে বলেন। তখন শহরজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো। কিন্তু সৈয়দ মহসীন আলী যা পারেন তা যে অন্য কেউ পারেন না। তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমাকে বলেছিলেন সত্য যা বলেছি তাতে আমার কোন লজ্জা নেই। তিনি বলেছিলেন, এই জমিটা একদিন সবাই ভোগ করবে অথচ আমার সমালোচনা করতে কেউই পিছপা হননি। হয়েছেও তাই সমালোচকরা প্রতি বছর ঈদ উল ফিতর ও ঈদ উল আযহার নামাজ ওখানেই পড়েছেন।
মৌলভীবাজার পৌরসভা তাঁর সময় আধুনিক ও গতিশীল ছিলো অন্য যেকোন চেয়ারম্যানের আমলেও চেয়ে। তিনি ২১/০৩/১৯৮৪ সাল থেকে ৩০/০৯/১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথমবার, ২৭/০২/১৯৮৯ সাল থেকে ০৪/০১/১৯৯২ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বার এবং ১৫/০৩/১৯৯৩ সাল থেকে ০৭/০৪/১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তৃতীয়বার পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি পৌরসভার দক্ষিণপাশে আধুনিক ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর সময়ে প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারী স্বাচ্ছন্দে কাজ করতেন। তিনবারের নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধির হাত ধরে মৌলভীবাজার শহরের আধুনিক সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিক সুবিধাগুলো বাড়াতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন।
তাঁর তিন মেয়াদের চেয়ারম্যান থাকাকালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অনেক কাজ ও সিদ্ধান্ত ওখানেই নেওয়া হতো। তখনকার সময়ে অনেককেই তাঁর কাছে যেতে দেখতাম। যারা আজ তাঁকে স্মরণই করতে চায়না। অথচ সেসময়ে মহসীন আলীর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহসও অনেকেরই ছিলোনা। আর সিদ্ধান্ততো তিনিই নিতেন কারণ তিনি ছিলেন তখনও বীর। অতীত ভুলে রাজনীতির কারণে হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় অনেকেই বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও তাঁর প্রতি সংকীর্ণ মন-মানসিকতা দেখানো নিজেদের অক্ষমতাই প্রকাশ করা বলে মনে করি।
তিনি ছিলেন একজন মন্ত্রী, একজন অভিভাবক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন সাংবাদিক, ছিলেন একজন পৃষ্ঠপোষক। তার চলনে বলনে কথাবার্তায় সদা ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। একথাগুলোই এখন বলছেন তার গুণগ্রাহী, সম-সাময়িক রাজনীতিবিদ, বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে তার নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ।
তিনি তার এলাকায় ছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে যেমনি বীরত্ব দেখিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। তেমনি ২৫ বছর জনগণের ভোটে পৌর চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হয়ে ওঠেন সকলের কলিজার টুকরা। একারণেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানকে প্রায় ৩২ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে মৌলভীবাজার-৩ (সদর ও রাজনগর) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে এলাকার জনগণ।
অসম্ভব খোলা মনের মানুষ তিনি ছিলেন। জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতা থেকে তার উপর বর্তানো অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলেন তিনি অনেকটা নীরবে। তবে তার অসমাপ্ত এই কাজগুলো এগিয়ে নিতে তার সহধর্মিনী সুখ-দুঃখের একান্ত সহচর সৈয়দা সায়রা মহসীনকে নির্বাচনী এলাকার দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও স্বামীর মতো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জন্য।
তাঁর প্রস্থানে আর কোনদিন তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা যাবে না। শোনা যাবে না তার দেশাত্ববোধক গান। আর মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের বলবেন না, তোমরাতো আমার আত্মীয়, আমার সহকর্মী ও আমার আপনজন। তিনিই একজন মন্ত্রী ছিলেন যিনি বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে ক্ষমা চেয়েছেন এবং যিনি গান করতেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তিনি মনে করতেন, ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ আর গানের কথা ও গান দিয়েই মানুষের মন জয় করা যায়। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করা হয়েছিলো সেইভাবে মন্ত্রী হয়ে গান গেয়ে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন।
সেই ১৯৭১ সালের পর থেকে তার বাড়ির দরজা ছিলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তিনবারের পৌর চেয়ারম্যান, দুই বারের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর দীর্ঘ রাত জেগে তিনি মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। শেষ রাতে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার সকালে ওঠে পড়তেন। মঞ্চে প্রায়ই চোখ বুঁজে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, সারা রাত মানুষের জন্য ঘুমোতে পারিনি। তাই একটু জিরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দেশ ও মানুষের জন্য চিন্তা করি। এজন্য তিনি অনেক সমালোচনার মুখোমুখি ও হয়েছেন। তবে তিনি এজন্য কারো উপর রাগ করতেন না। মনটা সাদা ছিলো তাই সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করতেন।
বিভিন্ন সময়ে তার মন্ত্রীত্ব চলে যাবে বা চলে যাচ্ছে এসব গুজবের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, আমি গণ মানুষের জন্য কাজ করি, মন্ত্রীত্বের জন্য নয়। সারা জীবন আওয়ামীলীগ, মুক্তিযুদ্ধ ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ করেছি। আমি পদে মন্ত্রী না থাকলেও মানুষের অন্তরের মন্ত্রী আছি। তবে প্রধানমন্ত্রী আমার সততা ও নিষ্ঠার কথা জানেন। আর আমি ওসব নিয়ে ভাবিনা, ভাবি জনগণকে নিয়ে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির গরীব, দু:খী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাঁর মুক্তহস্তে দান ছিলো এ জেলার মানুষের মুখে মুখে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য তিনি ছিলেন একেবারে উদার। তার দায়িত্বকালে তাই অনেকেই চাকুরী পেয়েছেন। সহায় সম্পত্তি কিছু করেন নি কিন্তু মানুষের সম্মান, ভক্তি ও ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন তিনি।
কর্মজীবন:
২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ও একই সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য, সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সদস্য, জেলা ও বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে জয়ের পর তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য, ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের পুরষ্কার, ১৯৭৬-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মহকুমা/জেলা রেডক্রিসেন্ট এর সাধারণ সম্পাদক, চেম্বার সভাপতি, জেলা শিল্পকলার সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিয্দ্ধু ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ভারতের ‘আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০১৪ ও নেহেরু সাম্য সম্মাননা ২০১৪ পুরষ্কার পান।
তিনি ভারতের কোলকাতা থেকে এমবিএ ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। তিনি বাংলা, ইংরেজী, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ১৯৪৮ সালে ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহরের দর্জিরমহল এ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত সৈয়দ আশরাফ আলী ও মাতার নাম আছকিরুন্নেছা খানম। তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক।
তিনি মৌলভীবাজার পৌরসভার তিন বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজার সদর (মৌলভীবাজার-রাজনগর) আসনের দুই বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর জনসম্মুখে সিগারেট খাওয়া, সাংবাদিকদের কটুক্তিসহ বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে তার সৎ ও নিষ্ঠার রাজনীতির কারণে সারা জেলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো।
তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার:
প্রশ্ন : মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কি ছিল?
সমাজকল্যাণমন্ত্রী: হেসে বললেন, খুব একটা আপ্লুত হইনি। তবে এজন্য প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি এতকিছুর পরও আমার উপর ভরসা রেখেছেন। এরপর তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার মানসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এরপর একাত্তর সাথে মুক্তিযুদ্ধ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে। মানুষ আমাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সব সময়ই মূল্যায়ন করেছে। ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে কৃতজ্ঞ করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার পর দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হয়েছে। আমি চাই শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে দেশের কল্যাণে কাজ করে যেতে।
প্রশ্ন: বিভিন্ন সময়ে আপনার বক্তব্যে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠেছে, এতে আপনার প্রতিক্রিয়া কি ?
সমাজকল্যাণমন্ত্রী: আমি সর্বদা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি। কারণ যারা আমাকে নিয়ে কটুক্তি করে বা যথাতথা কথাবার্তা বলে। তাদের মাঝে সত্য বলার সৎ সাহস নেই। তাই এরা আমার বক্তব্যগুলোকে পুঁজি করে আমার স্থানীয় বিরোধীপক্ষরা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করেছে। একটা সময় মৌলভীবাজারে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে রাজাকাররা ঢুকে পড়ে। তারা একজোট হয়ে আমার পেছনে লাগে। কারণ আমি জানি তাদের বাবা-চাচা-দাদারা বাংলাদেশের টাকা হাতে তুলে নেয়ার চেয়ে পাকিস্থানের টাকাই বেশি পকেটে রাখতো। তাই আমার পেছনে লেগেছে, আমাকে নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা ছড়িয়েছে, কূট-কৌশল করেছে। কিন্তু দল ও নেত্রী আমার উপর ভরসা রেখেছেন তাই তাদের সব অপপ্রয়াস ভেস্তে গেছে।
প্রশ্ন: আপনি গান করেন কেন ?
সমাজকল্যাণমন্ত্রী: হেসে বললেন আমরা করবো জয় আমরা করবো জয়। তিনি বলেন, মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা বড় মাধ্যম সঙ্গীত। মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে যেভাবে এদেশের মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ব করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে। সেভাবে আমি চাই গানের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের আবেদন ছড়িয়ে দিতে। আর গানের কথা দিয়ে মানুষকে বেঁধে রাখতে। কারণ গানের মাধ্যমে একে অন্যের ভাষা খুব দ্রুত বুঝতে পারে।
প্রশ্ন: সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দেশ ও জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে আপনার পরিকল্পনা কি?
সমাজকল্যাণমন্ত্রী : এমপি থাকাকালীন আমার কর্মক্ষেত্র শুধু একটি আসন ছিলো। এখন আমার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সারা দেশব্যাপী বিস্তৃত। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনানুযায়ী কাজ শুরু করেছি। সারাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করা হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা চালু হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে এই মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে যতো কাজ রয়েছে তা সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: মৌলভীবাজার নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
সমাজকল্যাণমন্ত্রী: এটি আমার প্রাণের শহর। তাই এশহরকে প্রথমে সাজাতে হবে।
পৌর চেয়ারম্যান থাকতে কিছু করেছি আর এখন পরিকল্পনানুযায়ী বাকীটুকু করতে চাই। তিনি বললেন, শহরের ডিভাইডারের উপর ফলদ ও ফুলের গাছ লাগানো শুরু হয়েছে। এছাড়া বেরি লেইকে একটি পার্কে রুপান্তরিত করার কাজ চলছে। খেলাধুলার প্রসারের লক্ষে পুরনো ষ্টেডিয়ামকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। জেলার সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে অনেক অনেক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
এটিই ছিলো আমার নেওয়া তার সর্বশেষ সাক্ষাৎকার। লিখার লোভ সামলানো যায়না। যায়না নিজের হাতকে সংবরণ করা। জীবনের একটা নির্দিষ্ট আয়ূ আছে তা মনে হয় সবাই জানেন। একারণেই পরিচিতজনদের অনেকেই চলে যান আর আসবেন না বলে। হা-হুতাশ করি আমরা এক দুই দিন বা সপ্তাহ খানেক। তারপর ভুলে যাই দিব্যি। আমাদের সৈয়দ মহসীন আলী ও দেহত্যাগ করলেন কিন্তু মানুষের কলিজার টুকরো হয়ে রইলেন। তার সাথে আমার অনেক অনেক স্মৃতি রয়েছে। আবার অনেকেরই অনেক স্মৃতি রয়েছে তাকে ঘিরে। তা নিয়েই স্মরণের জানালায় তাকিয়ে থাকবো আজীবন।
মন্তব্য করুন