স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে হাওর তীরের মানুষ : হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী পরিবার গুলো আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত রোগে

May 22, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ খাদ্য সংকটে থাকা সর্বস্বান্ত হাওর পাড়ের মানুষের এখন নতুন উপদ্রব রোগ বালাই। এখন পানি বাহিত নানা রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী পরিবারগুলো আক্রান্ত হচ্ছে ডাইরিয়া,জ্বর,সর্দি,কাশি,আমাশয়,চর্মরোগ,কৃমি ও পেট ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ে। ঘরে তিন বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা যাদের নেই তারা রোগ তাড়াতে ওষুধ কেনার সাধ্য কোথায়। তাই বলতে গেলে এখন নিত্যদিন রোগের সাথে আপোষ করেই তাদের চলা। এবছর চৈত্রের অকাল বন্যার পর এখন এমন স্বাস্থ্য অবস্থা হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলোর কৃষি ও মৎস্যজীবীদের। টাকা নেই তাই শরীরও ভালো নেই। রোগ সারাতে মনোবল আর ধৈর্য্যই যেন একমাত্র পুঁিজ। মাঝে মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় অধৈর্য্য হলে রোগ সারাতে উপজেলা হাসপাতালে আসলেও সেখানে মিলেনা ডাক্তার কিংবা ওষুধ। আর অনেক সময় ডাক্তার পাওয়া গেলেও তাদের রুঢ় আচরনে মনে হয় শরীরে রোগ থাকাই ভালো। গ্রাম থেকে এত দূর  গিয়েও যদি ডাক্তার পেলে ওষুধ পাইনা। কিংবা ডাক্তারদের অবহেলার স্বীকার হতে হয় তাহলে ওই খানে চিকিৎসা নিতে আসব কেন। ক্ষোভে দু:খে এমনটিই জানালেন হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্ত  রোগাক্রান্ত কৃষি ও মৎস্যজীবীরা। জানা গেল হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার অংশের কুলাউড়া,জুড়ী ও বড়লেখা ৩টি উপজেলার মধ্যে ২টি উপজেলায় রয়েছে সরকারী হাসপাতাল। কিন্তু এই দুটি হাসপাতালেও রয়েছে ডাক্তার, ওষুধ ও লোকবলসহ নানা সমস্যা ও সংকট। আর যা আছে তারও স্বদব্যবহার হচ্ছেনা বলে ভোগত ভোগীদের তরফে রয়েছে নানা অভিযোগ। এবছর হঠাৎ চৈত্র মাসে হাওর উত্তাল হয়ে সব গিলে খেয়েছে হাওর তীরের বাসিন্ধাদের। ধানের পর মাছ। পোষা হাঁস,জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ সবই। হাওর থেকে ভেসে আসা মরা পচা উৎকট গন্ধ এখনো নাকে লাগছে। এমন বির্পযয় এর আগে কখনো দেখেনি তারা। হাওরে এ বির্পযয়ের পর এখন জালে মাছ  ধরা পড়ছে কম। এই মাছ বিক্রি করে জাল ভাড়াও উঠছেনা। তাই ঘরে যেমন খাদ্য নেই। তেমনি না থাকার তালিকা আছে ওষুধ ও অনান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষও। তাই হাওর জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। হাকালুকির তীরবর্তী অধিকাংশ বাসিন্ধাদের বসত ভিটা ছাড়া নেই তেমন ক্ষেত কৃষির জমি জমা। বোরো মৌসুমে অন্যের জমিতে বর্গা চাষ আর বছর জুড়ে হাওরে মাছ ধরাই তাদের কাজ। এ দু’কাজেই চলে তাদের জীবন জীবীকা। কিন্তু যে হাকালুকিকে ঘিরে তাদের বেচেঁ থাকার স্বপ্ন আর এই জনবসতি। সেই হাকালুকিরই নেই সেই আগের অবস্থা। নাব্যতা হ্রাসে এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ আর নানা দূর্লভ জীববৈচিত্রের অভায়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এশিয়ার অন্যতম হাওর হাকালুকির ঐতিহ্য এখন ধ্বংসের দোরগোড়ায়। আর এরপর এবছর অকাল বন্যায় সব সম্পদ হারিয়ে হাওর অনেকটা নি:স্ব। হাকালুকির এমন বেহাল দশায় ভালো নেই হাওর তীরের জেলেপল্লীর জনগোষ্ঠী ও কৃষিজীবীরা। হাকালুকির দুরাবস্থায় তাদের জীবন জীবকায়ও লেগেছে দৈন্যদশা। এমনিতে বছরের ৫ মাস কোনরকম মাছ ধরে সংসার চালালেও বাকী ৭ মাসই বেকার। এ বছর বোরো ধান পচে পানি দূষিত হয়ে মারা যায় মাছ। একারনেই তারা এখন পুরোপুরিই বেকার। এমন অভাব অনটনের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা অসুখ বিসুখ। সরজমিনে দেখা গেল হাওর তীরের অধিকাংশ ঘর বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের সু ব্যবস্থা নেই বল্লেই চলে। দারিদ্রতার কষাঘাতে র্জজরিত প্রতিটি শিশুই পুষ্টিহীনতায় জীর্নশীর্ণ। এমন নানা কারনসহ এবছর অকাল বন্যায় এখন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে হাকালুকি হাওর তীরের কৃষিজীবী ও জেলে পল্লীর বাসিন্ধারা।জানা গেল এখন প্রতিনিয়তই তারা আক্রান্ত হচ্ছেন ডাইরিয়া,জ্বর,সর্দি,কাশি,আমাশয়,চর্মরোগ,কৃমি ও পেট ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগে। হাকালুকি তীরের কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুরসহ কয়েকটি গ্রামে দেখা গেল তাদের এমন দৈনদশা।

বিশেষ করে জেলেপল্লী হিসেবে পরিচিত সাদিপুর গ্রামের অনেকের রান্না ঘরের পাশে স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশ আর অস্বাস্থ্যকর খোলা পায়খানা। খোলা ড্রেন দিয়ে ময়লা আবর্জনা পুকুরগুলোতে এসে পড়ছে। আর ওই নোংরা পানিতেই হাত পা ধোয়া,নিজেদের গোসল ছাড়াও গোসল সারাচ্ছেন গরু মহিষেরও। গৃহিণীরা গৃহস্থালির আসাবাবপত্র,কাপড়সহ বাসনপত্র আর খাবারের জিনিসপত্রও ধুচ্ছেন ওই পুকুরেই। স্যাঁত স্যাঁতে কর্দমাক্ত আর র্দুগন্ধময় পরিবেশ পুকুর জুড়ে। তারপরও পানির উৎস বা নিরাপদ পানি বলতেই তারা এই পুকুরটিকেই বেচে নিয়েছেন। কারণ প্রায় শতাধিক পরিবারের বিশুদ্ধ পানির ভরসা একটি মাত্র টিউবওয়েল। স্থানীয় বাসিন্ধারা জানালেন সবসময় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিবওয়েলের পানি দিয়ে এতসব প্রয়োজনীয় (ধুয়া মুছার) কাজ সারা সম্ভব নয়। তাই ওই পুকুরই তাদের ব্যাপক পানির উৎস। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনেকটাই অসেচতন ওই এলাকার নারী পুরুষ। একই পরিবারে পাশাপাশি বয়সের রয়েছে ৬-৭ টি শিশু সন্তান। অনেক পরিবারে ১০-১২ জন সদস্য আর হাঁস মোরগ ও ছাগলের জন্য ছোট একটি মাত্র বাঁশের বেড়ার জরাজীর্ণ ঘর। যে খানে কোনরকম গাদাগাদি করে একসাথে বসবাস তাদের। এখন বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন চর্ম রোগ,হাম রুবেলা,নিউমোনিয়া,ডায়রিয়া,ম্যালেরিয়া,টাইফয়েড,পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে। জানা যায় সম্প্রতি হাম রুবেলায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় হাওর তীরের সাদিপুর গ্রামের কালা মিয়া ও লিজা বেগম দম্পত্তির ৯মাসের মেয়ে রিমা আক্তার নামের একটি শিশু। জানা গেল ওই এলাকায় এ রোগে আক্রান্ত ওই পরিবারে ৫ বছরের একটি মেয়ে শিশুসহ ও আশপাশের আরো ৬-৭ টি শিশু। হাকালুকি হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন হাওরাঞ্চল তুলনামূলকভাবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় তারা উপজেলা হাসপাতালে এসে স্বাস্থ্য সেবা নিতে চান কম। তা ছাড়া ওই এলাকার বাসিন্ধাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা অনেক কম। যে কারণে তারা বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া এবছর অকাল বন্যায় বোরো ধান পচে হাওরের পানি দূষিত হওয়ায় পানি বাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি সার্বিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে আমাদের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com