হাওরপাড়ের সরেজমিন চিত্র- ঘরে ভাত নাই, কিসের নববর্ষ!
বিশেষ প্রতিনিধি॥ হাওর এলাকা থেকে ফিরে: ভাই, তিন বছর তনে বোরো ধান ঘরে তুলতাম পারিয়ার না, এবছর একটা ধানও ঘর তুলতাম পারছি। আমাদের কিসের নববর্ষ? বউ-বাচ্ছা নিয়া ভাত খাইয়া-বাচতাম কিলা ওকান চিন্তা করলাম। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন হাকালুকি হাওর পাড়ের কৃষক আজাদ মিয়া। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যখন নববর্ষের আমেজ বিরাজ করছে ঠিক তখন মৌলভীবাজারের হাওর তীরের এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। হাহাকার চলছে প্রতিটি কৃষকের ঘরে ঘরে। আগাম বন্যা আর উজানের ঢলের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে বোরো ধান, কপাল পুড়েছে কৃষকের। কৃষি বিভাগের প্রাথমিক পরিসংখ্যানে ২শ কোটি টাকার বোরো ফসল ক্ষয়-ক্ষতির যাতনায় তাদের মধ্যে চলছে হাহাকার। ফলে বোরো ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষিজীবি মানুষের জীবন জীবিকা যেখানে হুমকীর মুখে পড়েছে, সেখানে নববর্ষ উদযাপন নিছক কল্পনা বিলাস বলে অনেকে মন্তব্য করেন।
জানা যায়, ৩১ মার্চ দুপুর থেকে ৪ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত টানা ৪ দিনের বর্ষণে মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওর, বড়হাওরসহ ৭টি হাওরের সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। ধানের সোনাকানি ঝরার আগে সবুজ ফসল ডুবে যায় আগাম বানের জলে। ফসলের মাঠ সোনালী রূপ ধারণের পূর্বে কৃষকের স্বপ্ন ভেসে গেছে। বৃষ্টি থেমেছে, কমছে হাওরের পানি, থোড় অবস্থায় নিমজ্জিত হওয়ায় ফসলের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে বলে কুলাউড়ার কৃষি অফিসার জগলুল হায়দার।
হাকালুকি হাওর পাড়ের দক্ষিণতীরের ভুকশিমইল এলাকার শেখ জিয়াউর রহমান মিন্টু, আজাদ আহমদ, উজ্জল আহমদ, রিয়াজ উদ্দিন জানান, তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন বোরো ফসল। কোন কোন জমিতে থোড় বের হয়েছে, কোথাও থোড় বের হওয়ার আগে বৃষ্টি আর ঢলের পানির নিচে পচে নষ্ট হচ্ছে সারা বছরের খাদ্য। পরিবার পরিজনের নতুন বছরে কেমন করে আহার জুটবে সে চিন্তায় তাদের কাটছে দিন? এর মাঝে ঘর গেরাস্থালি পরিস্কার করে জল পান্তা আর মরিচ পোড়া খাবার কথা ভাবা তাদের কাছে দূ:স্বপ্ন বলে মনে করছেন।
তাদের নববর্ষের নবচেতনা হারিয়ে গেছে পানির নিচে। মহাজনের দেনা ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার নিকট থেকে আনা ঋণ পরিশোধ কেমন করে করবেন এই চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়েছে এমন কথা জানান সদর উপজেলার শেরপুর গ্রামের বেরিবিলে বোরো চাষ করা দুদু মিয়া।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মৌলভীবাজারে বোরো চাষের লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে দুই হাজার হেক্টর বেশী চাষ করা হয়েছিল। চাষকৃত প্রায় ৫৩ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে বানের পানিতে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১৭ হাজার ৪৩২ হেক্টর জমির ধান সমূলে বিনষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ফসল হারানোর শোকে কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে আর্তনাদের করুণ সুর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিডি মোঃ শাহজাহান মোবাইল ফোনে জানান, প্রাথমিক পরিসংখ্যানে মৌলভীবাজারে আগাম বৃষ্টি ও উজানের ঢলের পানিতে ২শ কোটির টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বন্যা কবলিত ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মধ্যে ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের প্রদান করা একশ’ মেট্টিক টন চাল এবং ৮ লাখ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে বন্টন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন