‘২৩ মার্চ একাত্তোর’ পাক প্রজাতন্ত্র দিবস, আমাদের প্রতিরোধ দিবস, স্মৃতিকথা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ তেইশে মার্চ একাত্তোর, পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস, ‘রিপাব-লিকডে’। ছাত্র লীগের নেতৃত্বাধীন-স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিবসটিকে ‘প্রটেষ্টডে’ প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষনা করেন। একাত্তোরের পহেলা মার্চ থেকে সমগ্র বাংলাদেশ উত্তাল আকার ধারন করে। সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে বাঙ্গাঁ-লিজাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন জনক-স্বাধীনতার মহানস্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করলেও পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তারে টালবাহানা করতে থাকেন।
বাংলাদেশে বঙ্গ বন্ধুর আহ্বানে শান্তি পূর্ণ আহিংস অসহ-যোগ আন্দেলন চলতে থাকে। একাত্তোরের পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের আসন্ন আধবেসন বাতিল ঘোষনা করলে বঙ্গবন্ধু নিন্দাজ্ঞাপন করতঃ ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলনের কর্ম সূচী ঘোষনা করেন। দোছরা মার্চ কলা ভবনে ডাকসুর ভিপি আশমরব লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তেছরা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র-লীগেরকেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে বিশাল ছাত্র সভায় ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সাধরন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইস্থে-হার পাট করেন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্র লীগের সংঘটক হিসাবে দুটি সভানুষ্টানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এটা আমার ছাত্র জীবনের গর্ব ও গৌরবের ব্যাপার। একাত্তোরে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে মাষ্টার্স ফাইন্যাল এর ছাত্র ছিলাম। ষাটের দশক থেকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। প্রথমে মৌলভীবাজার কলেজ শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলাম। আমার ‘ছ’ ফুিট দীর্ঘ দেহ, এক মাথা বাবরি চুল, বিশাল গোফ, উচ্চ কন্ঠ, শ্লোগান এবং দুঃসাহসীবক্তৃতার কারনে কেন্দ্রিীয়নেতাদের সু-নযরে আসি। মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র হলেও রাজনৈতিক কারনে রোজ বিকেলে পার্শ্ব বর্ত্তী তৎকালীন ইকবাল হলে চলে আসতাম। এই হলের একশত একষট্টি নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সমাজ সেবা সম্পাদক অগ্রজ প্রতিম গিয়াস উদ্দিন মনির ভাই। তিনি স্বাধীন বাংলা বি,সি,এস ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়ে সততাও সুনামের সাথে বৃটেনে হাই কমিশনার এর দায়িত্ব পালন শেষে অবসর জীবন যাপন করছেন। ছাত্র রাজনীতির প্রান কেন্দ্র এই হলেই দেখা মিলত ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারন সম্পাদক তাত্বিক সিরাজুল আলম খান, আশম রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্র ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে। এরা সকলে আমাকে খুবই স্নেহ করতেন – এখন ও করেন। উত্তাল মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা- সাতই মার্চ সোহরা ওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষন। ঢাকায় জলপনা কল্পনা ছিল, একজন কলম সৈনিক হিসাবে পত্র-পত্রিকা অফিসে আমার আসা যাওয়া ছিল, জেনেছি বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা ঘোষনা করবেন। সন্ধ্যা হলেই সামরীক সরকার সান্ধ্যআইন জারী করেতেন। সন্ধ্যা হলেই-ইয়হিয়ার ঘোষনা মানিনা মানবনা, স্বাধীনকর, স্বাধীনকর, বাংলাদেশ স্বাধীনকর, শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তপ্ত হত, ঢাকা নগরী।
আমরা-নিউক্লিয়াস-পথ্নী ছাত্রলীগ কর্মিগন, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত এলাকার সংগ্রামী জনগন সহ সিরাজ ভাইয়ের দিক নির্দেশনা মোতাবেক সান্ধ্য আইন ভঙ্গঁ করে মিছিলবের করতাম। ঐতিহাসিক সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গঁবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্টতম ঐতিহাসিক ভাষনটি দিলেন। আমাদের নেতা দাদা সিরাজুল আলম খাঁন ছাত্র লীগের কর্মি বাহিনীকে পোষ্টার লিফলেট, প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা সহ দলীয় কাজে যার যার এলাকায় পাঠিয়েদেন। আমি রঙ্গীন উত্তাল ঢাকাই জীবন পেছনেফেলে প্রিয় শহরে ফিরে আসি। আমি তখন মহকুমা ছাত্র লীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি। নতুন সভাপতিছিলেন সুদর্শনও সু-বক্তা দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী এবং সম্পাদক ছিলেন শক্তি মান সংঘট অকাল প্রয়াত নূরূল ইসলাম মুকিত। উভয়ের সঙ্গেঁ আমার সু-সম্পর্ক থাকার সুবাদে এখানে এসে আমি তাদের সঙ্গেঁ কাজ করতে থাকি, আন্দোলনে সংগ্রামে নেতৃত্বদেই। মহকুমার সব কটি আসনে এম.পি.এ এবং এম.এন.এ- আসনে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী গন বিগত সাধারন নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে ছিলেন। জেলা সদরের এম.এন.এ ছিলেন প্রবীনরোজনীতিবিদ ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং এম.পি.এ ছিলেন অগ্রজ প্রতিম এম.আজিজুর রহমান। দুজনের নির্বাচনে আমি খুব কাজ করে ছিলাম, উভয়েই আমাকে খুবস্নেহ করতেন দুজনেই এখন পরলোকে। মহান মালিক তাদের বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত। ছয় উপজেলার সীমান্ত বর্ত্তী মহকুমা মৌলভীবাজার সমগ্র মার্চ মাসেই উত্তাল ছিল। মিছিলে মিটিং এ সরগরম ছিল।স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এরনেতা চতুষ্টয়, রব, সিরাজ, সিদ্দিকি, মাখন হলেন-ডাকসুর ভিপি আশম, রব, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী শাহ জাহান সিরাজ, ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর জি.এস.অকাল প্রয়াত আব্দুল কদ্দুস মাখন।বঙ্গঁ বন্ধুর চার খলিফা হিসাবে সু-পরিচিতি এই চার নেতা দেশব্যপী সুপরিচিতও জনপ্রিয় ছিলেন। আমার সঙ্গেঁ ও পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল। স্বাধীন ব্ংালাছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এরনেপথ্যনায়ক ছিলেন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার গোপন সংগঠন নিউ ক্লিয়াস এর জনক তাত্বিক সিরাজুল আলম খাঁন। স্বাধীন বাংলাছাত্র সংগ্রম পরিষদ এর প্রতি সমগ্র দেশও জাতির আস্থা, বিশ্বাসও সমর্থন ছিল। তারাও ছিলেন নির্লোভ। দেশপ্রেমিক। তেইশে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে স্বাধীন বাংলাছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিবাদ প্রতিরোধ প্রটেষ্ট ডে ঘোষনা করতঃ বিভীন্ন কর্মসূচি ঘোষনা করেন। কেন্দ্রের ঘোষনা মোতাবেক আমরা স্থানীয় ভাবে দিবসটিকে উদযাপন করতে আলোচনাও মত বিনিময় করি ছাত্র লীগ ও কমিটি গত ভাবে সভা করেন।
এ ব্যাপারে মহকুমা ছাত্রলীগের সাবেক সম্পাদকমেধাবী রাজনীতিবিদ আমার পরমাত্বীয় অকাল প্রয়াত আব্দুল অদুদ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরীতে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করলে ও চৌমুহনাস্থ টেইলার বর্শিজুড়া-মাইজপারা নিবাসী আব্দুল বশির প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তিনি সাহসের সাথে স্বাধীন বাংলার পতাকা তেরী করে দেন। তেইশে মার্চ বিকালে চৌমূহনা চত্বরে ছাত্র গন জমায়েত পতাকা উত্তোলন এর কর্মসূচী মহকুমা ছাত্রলীগের পক্ষথেকে মাইক যোগে প্রচারিত হতে থাকে। শহরের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।তেইশে মার্চ একাত্তোর দুপুরের পর থেকেই চৌমূহনা চত্বরে শ্লোগান সহ মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। জয় বাংলা, স্বাধীনকর, স্বাধীনকর, বাংলাদেশ স্বাধীনকর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা-শ্লোগানে শ্লোগানে সমগ্র চৌমূহনা এলাকা প্রকম্পিত মুখরিত হয়ে উঠে। মহকুমা ছাত্র লীগেরনেতা দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপত্বিতে মহকুমা ছাত্র লীগের সম্পাদক সুদক্ষ সংগঠক নুরুল ইসলাম মুকিতের পরিচালনায় ঐসভায় আমি মহকুমা ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি এবং কেন্দ্রের সংগটক ও সভার প্রধান অতিথি হিসাবে সভার সভাপতি সম্পাদককে নিয়ে মূর্হমূর্হ গগন বিদারি জয় বাংলা শ্লোগনের মাধ্যমে চানতারা খচিত বিশাল পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াই, পাকিস্তানী জাতীর কথিতজনক বর্ণিত কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে বাঙ্গালি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের জনক স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উত্তোলন করি। সমগ্র চৌমুহনা চত্বরের চতুর্দিকে গগন বিদারী জয় বাংলা শ্লোগনের মাঝে ছবি ও পতাকা পুড়ানো ও উড়ানোর ছবি উঠিয়ে ছিলেন চৌমূহনাস্থ মুক্তা ফটোষ্টুডিও। তখন কারোই ব্যক্তিগত ক্যেমেরা ছিলনা, চৌমুহনায় শিশির ষ্টুডিও, পাহ্ণ ষ্টুডিও ছিল। তখন বয়স কম ছিল দেশপ্রেম আবেগ উত্তেজনা থাকলেও আইন-কানুন সম্মন্ধে ব্যাপক ধারনা ছিলনা। না হয় পাকিস্তান টিকে থাকলে জাতীয় পতাকার অবমাননা জনিতদেশদ্রোহীতার অপরাধে আমরা ও আমাদের কঠিন শাস্থি যাবতজীবন কারাদন্ড এমন কি মৃত্যুদন্ড ও হতে পারত।তখন এসব ভয় ভীতি আমাদের মধ্যে ছিল না। এর একদিন পরেই শুরু হয় মানব সভ্যতার ইতিহাসের কলংকময় অধ্যায়-“অপারেশন সার্চ লাইট” বাঙ্গাঁলি গন হত্যা। ধর্ষন। লুন্ঠন। দেশ স্বাধীনের পরশুনেছি শহর বাসি অনেককেই আমার ছবিদেখিয়ে “গুন্ডামুজিব ক্যাহা হায় উসকা পাতা বাতাও” বলে পাকসেনারা ঝুলুম নির্যাতন করেছে। ছাব্বিশে মার্চ সকালে আমার মুসলিম কোয়াটারস্থ পৈত্রিক বাস গৃহ ঘেরাও দিয়েছিল, কিন্তু আমি ঐ দিন ওই রাতে বাসায় ছিলাম না। ঐ রাতে আমি রাত্রি যাপন করেছিলাম আমার বিশিষ্ট বন্ধু মহকুমা ছাত্র লীগ এর প্রতিষ্টাকালীন সম্পাদক সাংবাদিক-সাহিত্যিক আজিজুল হক ইকবালের গীর্জাপাড়াস্থ বাসগৃহহক ভিলায়।তেইশে মার্চের সফল সভানুষ্টান শেষে জয় বাংলা শ্লোগান সহ আমরা সমগ্র চৌমূহনা এলাকা প্রদক্ষিণ আনন্দ উল্লাস করি। তেপ্পান্ন বছর পর তেইশে মার্চের উজ্জল স্মৃতি আমার মানষ পটে এখনও সমুজ্জল। ইতিমধ্যে মহান স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপিত হয়েছে। তেইশে মার্চের সংঘটক ছাত্র নেতার মধ্যে তোফায়েল আহমদ, আশম রব ছাড়া সকলেই পরলোক। স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতার সকল শহীদানের উজ্জল সমৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সকল বীর শহীদানের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। একাত্তোরের প্রিয় যুদ্দাহত সহযোদ্ধাদের জন্য গভীর সমবেদনা সহ রনাঙ্গঁনের প্রিয় সাথীদেরকে অভিনন্দন অভিবাধন।
লেখক : ষাটের দশকের ছাত্র নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, সিনিওর এডভোকেট হাইকোর্ট, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।
মন্তব্য করুন