সৈয়দ মহসীন আলী: ক্ষণজন্মা মানুষ ও রাজনৈতিক নেতা
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ দেশের খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী এক বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সোমবার সিঙ্গাপুর সময় সকাল ১০টা ৫৯ মিনিটে এবং বাংলাদেশ সময় সকাল ৮ টায় সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন(ইন্না লিল্লাাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। মৌলভীবাজারবাসী সহ দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর সামগ্রিক অবদান গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে এ লেখা শুরু করছি।
ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ মহসীন আলীর ব্যক্তিত্ব ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অবদান তুলে ধরা আমার মত একজন সাধারণ লেখকের দুঃসাহস ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও এ লেখার সাহস পেয়েছি শুধুমাত্র প্রয়াত নেতাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সৈয়দ মহসীন আলী জীবনের শেষ বেলায়ও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার জয়গান গেয়েছেন। তিনি মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের রাজনীতি করে গেছেন। এখন আর কোন মাননীয় মন্ত্রী মঞ্চে বক্তৃতা করতে করতে দেশাত্ববোধক গান ও “মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য” গাইবেন না। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। তিনি ছিলেন নরম হৃদয়ের দিলখোলা মানুষ। যাকে যা বলার প্রকাশ্যেই বলতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা সহ্য করতে পারতেন না। প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতেন। রাজনীতির সুবাদে মৌলভীবাজারের অলিগলি চষে বেড়াতেন সৈয়দ মহসীন আলী। তিনি ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের শেষ ভরসাস্থল। সৈয়দ মহসীন আলী মৌলভীবাজারের এক ঐতিহ্যবাহী বনেদি পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর মধ্যে কোন অহংবোধ দেখা যেত না। সর্ব শ্রেনী, মত ও পেশার মানুষের সাথে তিনি মিশতেন। তাঁর বাসভবনে যে কোন মানুষ গিয়ে তাঁর কাছে বসতে পারতো এবং নিজের সমস্যার কথা নিঃসংকোচে বলতে পারতো। এজন্যই তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, মহৎ মানুষ।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। মৃত্যুর প্রায় এক বছর পূর্বে একদিন সকালে প্রাত:ভ্রমণ শেষে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর বাসভবনে গিয়ে তাঁর পাশের চেয়ারে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে বসা দেখলাম, যাকে দেখলেই মনে হবে তিনি একজন সুবিধা বঞ্চিত কোনো পরিবারের মহিলা হবেন। তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে তার কথাগুলো বলতে লাগলেন। মন্ত্রী মহোদয় আমার চেয়েও বেশি ঐ মহিলাকে মনোযোগ দিলেন। এ দৃশ্যইতো সৈয়দ মহসীন আলীকে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা থেকে আলাদা করে দেয়। এ দৃশ্যই তাঁর মহানুভবতার বড় প্রমাণ বলে আমি মনে করি। তিনি শুধু রাজনীতিই করতেন না। তিনি ছিলেন সমাজ সেবায় নিবেদিত এক খ্যাতিমান মানুষ। তিনি অনেক সমাজসেবা মূলক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি গ্রেটার সিলেট ডেভলাপমেন্ট এন্ড ওয়েল ফেয়ার কাউন্সিল ইউ.কে এর মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পরে এ পদ তিনি ছেড়ে দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এ সংগঠনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে আমি তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আমরা সব সময় বড় মানুষ ও মহৎ মানুষের কথা শুনি কিন্তু বড় ও মহৎ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বড় মানুষেরা যখন উচ্চাসনে যান তখন তাঁদের অনেকেই জন মানুষ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু মহৎ মানুষেরা যখন উচ্চাসনে আসীন হন তখন তারা আরও বেশী মহৎ হন, মানুষের জন্য আরও বেশী অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। সৈয়দ মহসীন আলী এমনি একজন মানুষ ছিলেন যিনি মন্ত্রী হওয়ার পরও প্রায় প্রতি সপ্তাহে মৌলভীবাজারে চলে আসতেন। মৌলভীবাজারের মাটি ও মানুষকে তিনি যে ভালবাসতেন এটি একটি বড় প্রমাণ। সৈয়দ মহসীন আলী যে কোন পর্যায়ের মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একজন এম,পি হিসেবে, মন্ত্রী হিসেবে, পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে আমি তাঁকে দেখেছি। তাঁর সাথে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমাবেশে যোগ দিয়েছি। তিনি আমার লেখা বই ‘নির্বাচিত রচনা সংকলন’ এর মোড়ক উন্মোচনে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর বাড়িতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে গিয়েছি। আমার কাছে সব সময় দৃশ্যমান হয়েছে সৌজন্য, সহানুভূতি ও মানুষের মতামতের উপর গুরুত্ব দেয়ার এক সহজাত প্রবণতা তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কোনো ধরনের অহংকার বা অহমিকা তাঁর মাঝে দেখিনি। তিনি শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের নেতা হিসেবে নয়, যে কোন দলের বা মতের মানুষের নেতা হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বগুণ থাকার কারনেই এটি সম্ভব ছিল। তিনি আমাকে আমাদের ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটিকে জেলা ভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সকল উপজেলা থেকে কর্মকর্তাদের কো-অপ্ট করে নির্বাহী কমিটির পরিধিকে বর্ধিত করে জেলা ভিত্তিক সম্প্রসারণ করেছি। তিনি বিপদে-আপদে অকাতরে মানুষকে সাহায্য করতেন। এটা ছিল তাঁর স্বভাব সুলভ আচরণ। কথা বার্তায় চলনে-বলনে তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। দেশের জন্য তাঁর মতো দৃঢ়চেতা মানুষের খুবই প্রয়োজন ছিল। মহসীন আলী কখনো নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করেননি। আমরা জানি মৃত্যু অমোঘ সত্য, মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার শক্তি কারো নেই। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন কুল্লু নাফছিন জায়েকাতুল মউত অর্থাৎ নিশ্চয়ই প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মানুষ মরণশীল, মানুষের জীবন ফুরিয়ে যাবে, দেহ মিশে যাবে মাটির সাথে কিন্তু যে মানুষের কর্মজীবন মানুষের জন্য নিবেদিত থাকে। তিনি চিরস্মরণীয় অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকেন। মহৎ প্রাণ মানুষের মৃত্যু ঘটে না, তাঁর কর্ম ও সৃষ্টিশীলতা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল। “কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের মতো তুচ্ছ আর কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী।” সৈয়দ মহসীন আলীর মৃত্যুও পাহাড়ের মতো ভারীই দৃশ্যমান হয়েছে মানুষের কাছে। যার প্রমাণ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বুধবার মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর নামাজে জানাযায় দলমত নির্বিশেষে লাখো মানুষের ঢল।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মৃত্যুই আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা সকল মানুষই এ পথের যাত্রী। সকলকে মনে রাখতে হবে নৈতিক গুণ সম্পন্ন মানুষ হতে পারার মধ্যে ইহকাল এবং পরকালের সাফল্য নিহীত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি কবিতায় অসাধারণভাবে মানুষের মহাপ্রয়াণ বিষয়ে প্রত্যয় জাগিয়ে গেছেন-
“তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বার বার চিহ্ন তব আছে পড়ে
তুমি হেথা নাই।”
মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে দোয়া করি সৈয়দ মহসীন আলীর জনহিতকর কাজগুলো যেন মহান আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন এবং তাঁকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
লেখক-মোহাম্মদ আবু তাহের সভাপতি ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি।
মন্তব্য করুন