ঢাকা-সিলেট ঝুঁকিপূর্ণ রেলসড়কে ঘন ঘন দুর্ঘটনা : কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কবে

মো: মুহিবুর রহমান : ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্ব—বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের রেলপথ আজ ভাঙাচোরা, ঝুঁকিপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত সেবার কারণেই মানুষের জন্য মৃত্যুহুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭ অক্টোবর সকালে সিলেটের মোঘলা বাজারে উডায়ান এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ফের একবার এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন উস্কে উঠেছে — এতে লক্ষ্যনীয়ভাবে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং আহতের খবর এসেছে।
এই ঘটনা কেবল একক দুর্ঘটনা নয় বরং দীর্ঘদিনের অবহেলার একটি ধারাবাহিক ফলাফল। ২০১৯ সালের ২৩ জুন কুলাউড়ার বরমচালে উপবন এক্সপ্রেসের এক ভয়াবহ লাইনচ্যুতে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছিলেন ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছিলপ্রশ্ন তখনও একই, ঝুঁকিপূর্ণ বগি, দুর্বল অবকাঠামো ও রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি কি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল? সেই ঘটনার তদন্তেও নানা কারণ দেখানো হয়েছিল।
আরও চোখে পড়ার মতো বড় দুর্ঘটনার কাহিনি আছে। ২০২৩ সালের এক রেল সংর্ঘষে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো ক্ষতির তালিকা তৈরি হয়েছিল-দশকের পর দশক চলে আসা অব্যবস্থা কখনোই দূর হয়নি। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিটি পরিবারের জন্য ভয়, আর পুরো সমাজের জন্য বিপদসঙ্কেত।
অবকাঠামো-দূর্বলতা ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হল—টিকিট কালোবাজারি ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাব। সরকারি ও আধুনিক অনলাইন সিস্টেম চালুর পরও টিকিট ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া’, সার্ভার হ্যাকিং বা কৌশলে টিকিট দখল করে কালোবাজারিতে বিক্রির অভিযোগ বারবার উঠেছে সরকারের সংস্থাগুলোর অভিযান থাকলেও সমস্যা স্থায়ীভাবে পৌঁছায়নি। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি অ্যান্টি-করাপশন কমিশন সারিক অভিযান চালিয়েছিল টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে, সেটাও হলো অস্থায়ী দমন; মূল ব্যবস্থাগত স্বচ্ছতা ফের আসে নি।
প্রধান সমস্যা ভঙ্গুর ও পুরনো রেললাইন লাইনচ্যুতি ও বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণ: ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও কুয়িক-কলাপ (dead-stop চিহ্ন থাকা সেতু এবং যথাযথ সংস্কারের অভাব)। পুরনো বগি ও রক্ষণাবেক্ষণে নিম্নমান (যাত্রীদের আরাম ও নিরাপত্তা উভয়েরই ক্ষতি)। টিকিট কালোবাজারি ও অনলাইন টিকিটিংয়ে স্বচ্ছতার অভাব, যাত্রীদের অধিক মূল্য দিতে হয় বা টিকিটই মেলে না। তদারকির অভাব ও দুর্নীতিসহ লোকাপেক্ষে জরুরি সংস্কারকাজ পিছিয়ে দেওয়া।
জনগণের দাবি
জরুরি পথ সংস্কার : ঢাকা—সিলেট রুটে দ্রুততর ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লাইন ও ব্রিজের জরুরি মেরামত (অবিলম্বে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকার ইঙ্গিত অনুযায়ী কাজ শুরু করা)।
স্থায়ী বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি: ঝুঁকিপূর্ণ সেতু প্রতিস্থাপন, নতুন বগি সরবরাহ ও আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম বসানো শুধু কথা নয়, নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে কাজ শুরু করতে হবে।
স্বচ্ছ টিকেটিং ব্যবস্থা: অনলাইন টিকিটিং এ লেনদেন স্বচ্ছতায় ব্যর্থ হলে স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের অডিট ও কড়াকড়ি জরুরি; কালোবাজারি মোকাবেলায় নিয়মিত অভিযানে দায়ী কর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাধীন তদন্ত ও জবাবদিহি: যে কোনো বড় দুর্ঘটনার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন যদি অবহেলা বা প্রতিবন্ধকতার কারণে দোষ থাকে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
জরুরি তহবিল ও স্বচ্ছ বরাদ্দ: রেল অবকাঠামো উন্নয়নে আলাদা সংকট তহবিল ঘোষণা ও তার পূর্ণ ও ধারাবাহিক বাস্তবায়ন, যাতে প্রতি বছর ধারাবাহিক সংস্কার চালানো যায়।
কথায় নয়, কাজে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বানরেলযাত্রা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন, ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো ও অস্বচ্ছ সেবার কারণে প্রতিটি পরিবার—বিশেষ করে দুরপাল্লার যাত্রী চিৎকার করছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের এই অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে অনাচার ও অবহেলার ফল। এখন আর অগ্রাহ্য করার সময় নেই-কর্তৃপক্ষকে তাদের ‘দায়িত্ব’ এবং জনগণের ‘অধিকার’ মধ্যে সাম্য বিধান করতে হবে।
সরকার, রেল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিস্ট সংস্থাগুলোকে এখনই দৃশ্যমান ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে—আপনি যদি আজ মঙ্গলার বাজারে লাইনচ্যুত ট্রেনের ঘটনায় আহত ও নিহতদের কথা ভেবে নীরব থাকেন, তাহলে এই অবস্থা যেন নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্তি হবে। জনগণের জীবন ও স্বাভাবিক যাতায়াতকে অগ্রাধিকার দিয়ে রেলপথকে নিরাপদ ও সম্মানজনক করে তুলতে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : মো: মুহিবুর রহমান, শিক্ষক, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন