আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর চায় শাক-সবজি ও ফলমূল বিক্রেতা মিনারা
![](https://i0.wp.com/www.patakuri.com/wp-content/uploads/2023/06/Minara-a-vegetable-and-fruit-seller-wants-a-house-in-the-shelter-project.jpg?fit=800%2C450&ssl=1)
মোঃ সালেহ আহমদ (স‘লিপক)॥ মিনারা বেগমের বয়স ৫০ বছর। শাক-সবজি ও ফলমূল বিক্রি করে সংসার চালান। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রের যতটুকু সময় রাস্তায় মানুষ চলাচল করে ততক্ষণ ভাসমান দোকান খোলা রাখেন।
এ থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে চলে ৭ জনের সংসার। মিনারা কখনো তরিতরকারি, শাকসবজি আবার কখনো ফলমূল নিয়ে মৌলভীবাজার শহরের হিলালপুরস্থ বাহারমর্দান রাস্তার মুখে বসে থাকেন। আবার মাঝে মধ্যে এসআর প্লাজার সামনেও গিয়ে বসেন।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর নরপতির এশ্বাদ উল্লার মেয়ে মিনারাকে ১৯৭৫ সালে বিয়ে দেয়া হয় মৌলভীবাজার শহরের গোবিন্দশ্রী এলাকার ফজিল মিয়ার সাথে। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর স্বামীর বাড়ির লোকজন মিনারাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
পরিচয় হয় কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজারের হারুনুর রশীদের সাথে। তাদের বিয়েও হয় শরিয়তসম্মত ভাবে। কিন্তু বিধি বাম! তাদের ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে জন্মের পর ২০০৭ সালে হারুনুর রশীদও মারা যান। ছোট্ট ৪ বাচ্চাসহ আবারো বের করে দেয়া হয় স্বামীর বাড়ি থেকে।
বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসেন মৌলভীবাজার শহরে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে বাচ্চাদের নিয়ে কোনরকম ভাড়াবাড়ীতে থাকেন। একমাত্র মেয়ে আয়েশা আক্তারকে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে দেন হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ রামশ্রী গ্রামের রাজমিস্ত্রী বাবুল মিয়ার কাছে। ২ নাতিন জন্মের পর মেয়ের জামাইও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াতে ২ নাতিনসহ মেয়ে এসেছে মিনারার সংসারে।
২ নাতিন স্থানীয় শাহ হেলাল উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্নজনের সহযোগিতায় লেখাপড়া করছে। বড় ছেলে দুলাল মিয়া সংসারের একমাত্র কর্মক্ষম ছিলো। সিএনজি চালিয়ে যা পেত তা দিয়ে কোনরকম সংসার চলে যেত। দূর্ভাগ্য, ২০১৯ সালে সরকার বাজার এলাকায় হবিগঞ্জি বিরতিহীনের সাথে সংঘর্ষে ছেলেটা মারা যায়।
২য় ছেলে জালাল মিয়া দিনমজুরের কাজ করেন। আর ছোট ছেলে বেলাল মিয়া টমটম চালায়। মিনারার সংসারে বৃদ্ধ মা, ২ নাতিনসহ বিধবা মেয়ে এবং ২ ছেলে মিলে মোট ৭ জনের সংসারের ঘানি তিনি একাই টানছেন।
দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ বছর ধরে পশ্চিম মোস্তফাপুর, খিদুর ও পূর্ব হিলালপুর এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন। বর্তমানে বসবাস করছেন মোস্তফাপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডস্থ খিদুর গ্রামে সেলিম মিয়ার পাশের বাসায় ৪ হাজার টাকা মাসিক ভাড়াতে।
দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মিনারার জীবন শুরু থেকেই কষ্টের। ৩ সন্তানকে লালনপালন করে বড় করা। এখন আবার বৃদ্ধ মা এবং বিধবা মেয়ে ও তার ২ সন্তানের দায়িত্ব নিতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবেই চলছে মিনারার সংগ্রামী জীবন।
টিকে থাকতে তিনি বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন। এখন তিনি শাক-সবজি ও ফলমূল বিক্রি করে তিন বেলা নিজের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যবসার পুঁজি দিয়েছেন আশপাশের বেশ কয়েকজন। তাদের কাছে তিনি ঋণী।
শনিবার ৩ জুন সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার শহরের হিলালপুরস্থ বাহারমর্দান রাস্তার মুখে ফলমূল নিয়ে বসে থাকা মিনারার সাথে কথা হয়। তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি রাস্তার মুখে এক প্রান্তে ফুটপাতে বসে কখনো শাকসবজি, কখনো ফলমূল বিক্রি করি। এসব বিক্রি করে ৭ জনের জীবিকা নির্বাহ করি।
তিন বেলা খাওয়া ও ঘরভাড়ার খরচ জোগাতে কিছু না কিছু তো করতেই হবে। এসব বিক্রি করে ২/৩ শ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই কোনরকম টেনেটুনে চলি। জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে এ আয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। মাংস খাওয়া হয় না অনেক দিন ধরে।
ডিম, ডাল ও সবজি বেশি খাওয়া পড়ে। তিনি আরও বলেন, স্বামী ছাড়া একজন নারীর পক্ষে সন্তান মানুষ করা ও সংসার চালানো খুবই কষ্টের। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় এবং স্বামী মারা যাওয়ায় আমাকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ সংগ্রাম হয়তো শেষ হবে।
মিনারা বেগম বলেন, ‘সরকার তো মাইনশরে ঘর দের। আমারে যদি একটা ঘর দিত তে ভাড়ার দিকে কিছুটা টেনশন কমলনে। আমার বাসার গালাত হিলালপুর আশ্রয়ন কেন্দ্রে অনেক ঘর খালি আছে। জেরারে দেওয়া অইছে তারা থাকের না। আর আমি থাকার জেগা পাইরামনা। আমারে একটা থাকার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়ার লাগি সরকারর গেছে দাবী জানাইরাম।’
মিনারাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন খিদুর গ্রামের রুয়েল আহমদ। তিনি বলেন, হার না মানা সংগ্রামী নারী মিনারা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে টিকে থাকার শক্তি, সাহস ও মনোবল তাঁর আছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাকে একটি ঘর দিলে, সে হয়তো একটু ভালোভাবে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারতো।
মন্তব্য করুন