কুলাউড়ায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরোধে উত্তেজনা বাড়ছে

January 4, 2024,

মো: মছব্বির আলী॥ আর মাত্র দুই দিন বাকি। দুটি রাত পেরোলেই দেখা মিলবে ভোটের রবির। দিনটি রোববার, ৭ জানুয়ারি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সেই সকালের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে স্নায়ুচাপের সাথে বাড়ছে নখ কামড়ানো উত্তেজনাও। দিন ঘনিয়ে আসায় উৎসব মুখর পরিবেশ পাড়া-মহল্লায়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রার্থী আর সমর্থকেরা ছুটছেন ভোটারদের কাছে। এরমধ্যে আওয়ামীলীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কথার লড়াই চলছে ভোটের মাঠে। প্রচার-প্রচারণায় প্রতিদিনই চলছে তাদের বাহাস। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ভোটের সমীকরণ। এমন অবস্থা মৌলভীবাজার-২ কুলাউড়া আসনে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রার্থী কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এর বিরুদ্ধে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একই দলের উপজেলা কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এ কে এম সফি আহমদ সলমান নির্বাচনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। দলের দুই নেতার নির্বাচনী লড়াইয়ে এ আসনের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে একে অপরকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে হুমকি-ধামকিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। একে অপরকে আক্রমণাত্মক বক্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নেট দুনিয়ায় সেটি নিয়ে চলছে নানান সমালোচনা।
এ আসনে মোট ৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতায় নামলেও মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সফি আহমদ সলমান ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক দুই বারের সংসদ সদস্য এম এম শাহীনের মধ্যে।
এ তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রচার-প্রচারণায় নির্বাচনী বক্তব্যে আওয়ামীলীগের প্রার্থী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমানের মধ্যে চলছে কথার লড়াই। প্রতিটি নির্বাচনী সভার বক্তব্যে একজন আরেকজনকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য রাখছেন, জনসমুক্ষে তুলে ধরছেন একে অপরের দুর্নীতির ফিরিস্থি, এতে বাড়ছে উত্তাপ। আতঙ্ক বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। অন্যদিকে নীরব প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী এম এম শাহীন।
বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীর (সফি আহমদ সলমান) এর সমালোচনা করে কড়া বক্তব্য দেন শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। সরাসরি নাম না বললেও তার বক্তব্য যে স্বতন্ত্র প্রার্থী সফি আহমদ সলমানকে ইঙ্গিত করে, তা বুঝা গেছে। নাদেল বলেন, বিভিন্ন মানুষকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কোনো নেতাকর্মী, ভোটারকে যদি হুমকি দেওয়া হয়, কারও দিকে যদি আঙুল তোলা হয়, সেই আঙুলের ঠিকানা কোথায় হবে তা ৭ তারিখ দেখা হবে।
মাইনষর চেয়ে শক্তিশালী আর মাইনষর চেয়ে বড় সন্ত্রাসী আর কেউ অইত পারে না। ৭ তারিখ মোটামোটি আমরা জানাযা পড়িলাইমু। আর জানাজার পরে দোয়া কিন্তু রেণু ভাইয়ে (উপজেলা আ’লীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেণু) করবা।
রেণু ভাই কিন্তু ভালা দোয়া জানইন। দোয়াতো আমরা হখলে করি। কিন্তু রেনু ভাই দোয়া করিয়া যেন একটা পাপ করছইন। দোয়াটা কেনে করলা। ইটার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে শেষ। আল্লার গেছে কোনতা চাইতাম নায়নি। কেউরে জিগানি লাগব নি। তুমি কোন হালা যে তুমারে জিগাইয়া দোয়া করা লাগব।
আমরার শক্ত প্রতিপক্ষ নাই। শক্ত প্রতিপক্ষ হইলে হাসি থামসা করা গেলনে। সহজ নির্বাচন আমরা সহজভাবে নিতাম। ইলেকশনে সম্ভাবনা না থাকার লাগি আপনারে সতর্ক থাকা লাগব। একটা জিনিস পরীস্কার। এই ইলেকশন সুষ্টু অইব। কেউ ঝামেলা করলে তেড়িবেড়ি করলে প্রশাসন পাখির বাইচ্চারে যেলা ধরিয়া নেয় ওলা নিব। বিয়াত যাইতে তো জামাইর লগে বর যাত্রী লাগে। এরা অইলা (প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীরা) বর যাত্রী। আমি তো চিন্তা করিয়ার ইলেকশনের আগেনি এরা তইয়া হরি যায়। তে তো একলা বিয়াত যাওয়া লাগব।
নাদেল বলেন, আমরা উন্নয়ন চাই, শান্তি চাই। আমরা সন্ত্রাস চাই না। আমরা মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। আমরা পর পর তিনটা নির্বাচনে কুলাউড়ায় ট্রেন মিস করেছি। বাংলাদেশ আজকে কোথায়। আমাদের কুলাউড়া কোথায়। সারাদেশ এগিয়েছে, আর আমরা পিছিয়েছি। এই কারণে আজকে শুধু আওয়ামীলীগ নয়, যারা জীবনে নৌকায় ভোট দেননি। তারাও আজকে নৌকায় সমর্থন জানিয়েছেন।’
বিগত ইউনিয়ন নির্বাচন বলেন, উপজেলা নির্বাচন বলেন; অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে। আমরা কি আবারও এগুলো দেখতে চাই? যারা বিগত নির্বাচনগুলোর মতো চিন্তাভাবনা করছেন, তাদের বলছি। তারা নিজেদেরকে সংশোধন করুন। ভোটারদের ভয় দেখিয়ে নয়, হুমকি দিয়ে নয়। মানুষের ভোট, মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলুন। এই কুলাউড়ার মানুষকে হুমকি দিয়ে ভোট আদায় করা যাবে না। কোনো কোনো জায়গায় পায়ে ধরেন। আবার আরেকটা হাত ঘাড়ের ওপর রাখেন। এইগুলো মানুষ বুঝে গিয়েছে। গুন্ডামি, জমি দখল, আমানতের টাকা খেয়ানত। অনেক মানুষ সহ্য করেছে। অনেক সম্মানিত মানুষ অসম্মানিত হয়েছে। ধর্মের কল বাসাতে নড়ে। সময় হয়েছে কুলাউড়ার মানুষ জবাব দেবে। ৭ তারিখের অপেক্ষায়। এই জনপদ কোনো সন্ত্রাসী বা কোনো বাটপারের কাছে যাবে না।
অপরদিকে বিভিন্ন সভায় আওয়ামীলীগের ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমান বলেন, বিভিন্নভাবে নির্বাচনী সভায় আমাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। আমার সমর্থকদের হুমকি-ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমি কুলাউড়ার নাগরিক। কুলাউড়ায় আমার জন্ম। আমি বা আমার অনুসারী কাউকে কুলাউড়ায় উঠতে দেবেন না। এমন কোনো বাবার সন্তান এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করে নাই। নাদেল অজস্র মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। সে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে লালন করে। কুলাউড়ায় এসে পীর সেজে লম্বা লম্বা কথা বলছেন, নাদেল সিলেট যে বাড়িতে বসবাস করে সেটি সুভাষিণী দেবী নামে এক হিন্দু মহিলার। জবরদখল করে ওই বাড়িটি সে বিনা দলিলে বসবাস করছে। নাদেল সিলেটে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি দখল করে জোরপূর্বক দোকান কোটা নির্মাণ করেছে। সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাড়ে ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। দুদকে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নাদেল সিলেট ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে বিচারাধীন আছে। এসব খবর দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা কি দেখিনি। আপনার বিরুদ্ধে মানুষ সিলেটে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে, পুলিশ দিয়ে আমার লোকজনকে ধরিয়ে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন? পুলিশ কি আপনার বাবার? পুলিশ আমার লোকদের কি করে ধরে আমি দেখে নেবো।
সলমান বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। আর যদি এ ধরণের কথা শুনি, যেখানে শুনবো সেখানেই ঠেকিয়ে দেবো।’’ ৭ তারিখ নাকি আমার জানাযা হবে। আমি নাকি তার শালা। রেনু ভাই নাকি জানাযার দোয়া পড়াবেন। কোন মুসলমান এমন কথা কেউ বলতে পারে। আচ্ছা বলেন তো কোন মানুষের মৃত্যু কখন আসবে সেটা কি মানুষ বতে পারবে। জানেন তো একমাত্র আল্লাহ। কোন নাস্তিক ছাড়া সে জানাযার দাওয়াত দিতে পারে? বিচার আপনাদের বিবেকের কাছে দিলাম।
সলমান বলেন, আওয়ামীলীগ প্রার্থী কুলাউড়ার মানুষ নয়, এবার নৌকা নিয়ে যে এসেছে তার বাবার বাড়ি কুলাউড়ার কৌলা গ্রামে। জন্ম, রাজনীতিসহ সকল সুকর্ম-কুকর্ম সিলেটে। থাকেন সিলেট এবং ধানমন্ডিতে। দায়িত্ব তার ময়মনসিংহ বিভাগে।’’ তাকে কুলাউড়ায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন কিছু টাউট বাটপাররা। আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে কারা ঘিরে রেখেছে, দেখছেন। একটা দালাল চাটুকার চক্র। আপনারা ভোট দিবেন, ভোট চলে যাবে ময়মনসিংহ। ভোট দিবেন প্রার্থী চলে যাবে ঢাকা। আর কুলাউড়ার মানুষ এই দালালদের খপ্পরে থাকতে হবে। তার ভোট কুলাউড়ায় নয়, তার ভোট সিলেটে। সে তার ভোটটি পর্যন্ত দিতে পারবে না। তাহলে সে এমপি হলে কুলাউড়ার কি উন্নয়ন করবে।
সফি আহমদ সলমান উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, বিগত দিনে যাদের ভোট দিয়েছেন। বন্যা গেলো, করোনা গেলো। ট্রেন দুর্ঘটনা গেলো। ভয়াবহ দুর্যোগে তাদের পেয়েছেন। বর্তমান-সাবেক এমপি কেউ নেই। কুলাউড়ার জনগন যেনো আল্লার হাওলা। আমি আপনাদের সন্তান। আমি এখন জীবন সায়াহ্নে। আমাকে ভোট দিয়ে কুলাউড়ার ভাগ্যাকাশ থেকে দুর্যোগের ঘনঘটাটা সরিয়ে দিন। আমাকে নির্বাচিত করুন। আমি আপনাদের পাশে থাকব।
এদিকে নির্বাচনী প্রচারণায় পরস্পরের সম্পর্কে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় কুলাউড়া আসনের প্রার্থীদের ডেকে সতর্ক করে দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ঊর্মি বিনতে সালাম গত ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর কার্যালয়ে প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থীদের ডেকে বৈঠক করেন। বৈঠকে কয়েকজন প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেন। সতর্ক করার পরও কোন প্রার্থী তা আমলে নেননি। একে অপরকে সমানতালে বিশেষদাগার করেই চলেছেন।
এদিকে সাবেক দুইবারের এমপি এম এম শাহীন তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন সক্রিয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নেতা ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তৎকালীন এমপি ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মনসুরকে পরাজিত করে দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন। এ নির্বাচনে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও তৃণমূল বিএনপির সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে গেলে অবাক হবার কিছুই থাকবেনা।
এ আসনের বর্তমান এমপি সুলতান মনসুর আহমদ নৌকা বঞ্চিত হওয়ায় তিনি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ২০১৮ পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। সবসময় স্রােতের বিপরীতে অবস্থান নেয় এ উপজেলার মানুষ। এ আসনে ১৫ বছর পর আওয়ামীলীগের নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো দলের মনোনয়ন পান দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।
এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতায় রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল মতিন (কাঁচি), জাতীয় পার্টির আব্দুল মালিক (লাঙ্গল), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এনামুল হক মাহতাব (মোমবাতি), ইসলামী ঐক্যজোটের আছলাম হোসাইন রহমানী (মিনার) ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মো. কামরুজ্জামান সিমু (কুলা)।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ আসন। এ আসনের ১৩টি ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভায় মোট ভোটার রয়েছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭২। এরমধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩৫ এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ জন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com