কুলাউড়ায় ওয়াক্ফ সম্পত্তির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ, নিয়ম ভেঙ্গে জমি বিক্রি
মাহফুজ শাকিল॥ কুলাউড়ায় হাজী ছোয়াদ উল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বর্তমান মোতাওয়াল্লির বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা (নং-৩৭৯) স্বত্ব দায়ের করেন মৃত হাজী ছোয়াদ উল্লাহ’র নাতি আব্দুল খালিছ নামে এস্টেটের এক ওয়ারিশ। এদিকে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে তদন্ত করেছেন ওয়াক্ফ মৌলভীবাজারের পরিদর্শক মোঃ আলাউদ্দিন।
অভিযোগে জানা যায়, ১৯৫৬ সালের ৯ অক্টোবর কুলাউড়া উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের মৈষাজুরী গ্রামের বাসিন্দা মৃত হাজী ছোয়াদ উল্লাহ মৈষাজুড়ী মৌজায় (এস এ জে,এল নং-৯৫, আর, এস জে, এল নং- ৫৪, এসএ খতিয়ান নং- ১৩১, ৪১২, ১৮৫, ৮৮, ১২৩, আর, এস খতিয়ান নং- ২৯৫, ৬৩২, ৭৩৬, এস, এ দাগ নং- ১৮৯, ১৯১, ১৯৬, ১৯২, ১৭১, ১৬৯, ১৭২, ২০১, আর এস দাগ নং- ১৫৬, ১৫৯, ১৬১,১৬২, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫, ৪০৯, ১৬০ সাইল রকম মোট মোয়াজি ৭.৩৯ একর ভূমি ৬৯৮০ নং ওয়াক্ফ নামা কবালামূলে ভূমি শর্ত মোতাবেক ওয়াক্ফ করেন। কবালার শর্তানুযায়ী ছোয়াদ উল্লাহ ঘোষণা করেন যে, তাঁর বাড়ির সামনে মক্তব (বর্তমানে মৈশাজুড়ী জামে মসজিদ), ব্রাহ্মণবাজার জামে মসজিদ, কুলাউড়া দক্ষিণবাজার জামে মসজিদ, কৌলা বড়বাড়ী জামে মসজিদ, চৌধুরীবাজার জামে মসজিদ ও চৌধুরীবাজার শাহী ঈদগাহ্ ছোয়াদ উল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের অংশীদার। ছোয়াদ উল্লাহ মারা যাওয়ার পর মোতাওয়াল্লী হিসেবে তাঁর বড় ছেলে মোঃ আজর আলীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আজর আলী ওয়াক্ফ দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালনা করেন। তারপর আজর আলী মারা যাওয়ার পর মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করেন তার বড় ছেলে আছরব আলী। আর সেই থেকে শুরু হয় ওয়াক্ফ এর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। আছরব আলী মারা যাওয়ার পর মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব পান তাঁর বড় ছেলে তবারক আলী। তবারক আলী মোতাওয়াল্লী থাকাবস্থায় ওয়াক্ফ জমির মাটি বিক্রি থেকে শুরু করে জমি পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এতে ওয়াক্ফ এর অন্যান্য ওয়ারিশসহ স্থানীয় এলাকাবাসী বাঁধা দিলে তিনি কোন নিষেধ মানেননি। তবারক আলী ইন্তেকালের পর মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব পান তার বড় ছেলে মাহবুবুর রহমান ইমন। ইমন মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ফের মাটি বিক্রি শুরু করেন। তিনি যখন ওয়াক্ফ জমি থেকে মাটি বিক্রি করে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে থাকেন তখন এলাকার লোকজন সহ ওয়াক্ফ এর অন্যান্য ওয়ারিশগণ বাধা নিষেধ প্রদান করেন। তখন ইমন এলাকার লোকদের বলে, “এটা আমার জমি আমি যা ইচ্ছা তা করবো, কিসের ওয়াক্ফ”। এর কিছুদিন পর ইমন প্রবাসে চলে গেলে তার মাতা হুসনে আরা বেগম মাটি বিক্রি শুরু করেন। এভাবে প্রতিনিয়ত জমি খনন করে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাটি বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বড় বড় দুটি পুকুর তৈরি করে সেই পুকুরে এখন মাছ চাষ করা হচ্ছে।
এসকল অভিযোগ পেয়ে গত ৩১ জানুয়ারী মৌলভীবাজারের ওয়াক্ফ পরিদর্শক মোঃ আলাউদ্দিন সরেজমিনে ওয়াক্ফ জমি পরিদর্শন করেন। এসময় এস্টেটের ওয়ারিশরা ও এলাকার লোকজন উপস্থিত থাকলেও মোতাওয়াল্লী মাহবুবুর রহমান ইমন ও তার মাতা হুসনে আরা বেগম উপস্থিত হননি।
নিয়ম অনুয়ায়ী ওয়াক্ফ প্রশাসনের অধীনে এসব সম্পদের দেখা শোনা করছিলেন ওয়ারিশরা। ওয়াক্ফ প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া এস্টেটের কোনো জমি থেকে মাটি বিক্রি বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করার নিয়ম না থাকলেও মোতাওয়াল্লি ইমন ও তার মাতা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে টাকার বিনিময়ে মাটি বিক্রি করেন এবং সেই টাকা আত্মসাৎ করেন। ইমন মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব নিয়ে এস্টেটের সম্পত্তি নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করলে অন্যান্য ওয়ারিশরা তার কাছে আয় ব্যয়ের হিসাব চান। কিন্তু তিনি কাউকে হিসাব না দিয়ে কালক্ষেপণ করেন এবং নিজের ইচ্ছামাফিক ওয়াক্ফ সম্পত্তি ভোগ ব্যবহার করছেন। এমন কার্যকলাপের এলাকার গণমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে ২০২৩ সালের ১২ মে মৈষাজুড়ী উত্তরপাড়া মক্তব ও জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্তমতে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং আইনী যাবতীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের জন্য কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এমতাবস্থায় কমিটির সদস্য আব্দুল খালিছ, শামীম আহমদ, সায়েদ আহমদ ওয়াক্ফ এস্টেটের ভূমি দলিলের শর্ত মোতাবেক ব্যবহার ও হিসাব নিকাশ আয় ব্যয় করার জন্য বর্তমান মোতাওয়াল্লী মাহবুবুর রহমান ইমন ও তার মাতা হুসনে আরা বেগমকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা উক্ত ভূমি তাদের ব্যক্তিগত বলে জানান। মোতাওয়াল্লী এবং তার মাতা নিজেদের ইচ্ছামত ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিধিভঙ্গ করে নিজেদের স্বার্থে ভোগদখল করছেন। বিষয়টির কোন প্রতিকার না পেয়ে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য ওয়াক্ফ কর্তৃপক্ষ ও আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন ওয়াক্ফ ওয়ারিশ আব্দুল খালিছ।
ছোয়াদ উল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের ওয়ারিশ আব্দুল খালিছ অভিযোগ করে বলেন, ইমনকে এস্টেটের মোতোয়াল্লী নিয়োগ করার পর থেকে দুর্নীতি চরম আকারে ধারণ করেছে। ইমন ও তার মাতা প্রায় ৩৫০ শতক জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বিশাল দুটি পুকুর খনন করে স্থানীয় দুই ব্যক্তি ছালেক মিয়া ও আলাউদ্দিনের কাছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লিজ দিয়েছেন। এছাড়া ইমনের পিতা সাবেক মোতাওয়াল্লী মৃত তবারক আলী ওয়াক্ফকৃত ২৪ শতাংশ জমি নিয়ম ভেঙ্গে ফয়েজ উদ্দিন আহমদের কাছে বিক্রি করেন। সেই ২৪ শতাংশ জমি বর্তমানে ফয়েজ উদ্দিন আহমদের নামে আর এস ৭৩৬ নং খতিয়ানে প্রস্তুত হয়। ইমন ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বর্ণিত সকল ভূমি নিজের ইচ্ছামাফিক ভোগ ব্যবহার করে আসছেন। এর কারণ জানতে চাইলে ইমন ও তার মাতা হুসনে আরা বেগমকে বার বার আপত্তি জানালে তারা কোন কথা না শুনে ভূমির মাটি বিক্রিসহ ওয়াক্ফ এষ্টেটের ভূমির ক্ষতিসাধন করে আসছেন। এমনকি ভূমির কোন উপস্বত্বাদি ওয়াক্ফ দলিলের শর্ত মোতাবেক অংশীদারদের দীর্ঘদিন যাবৎ প্রদান করছেন না। ওয়াক্ফ এর সম্পত্তির আয়-ব্যয়ের কোন হিসাব আমরা আজও পাইনি। এ ছাড়া ওয়াক্ফ প্রশাসনের তদন্তে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণিত হবে। তিনি আরো বলেন, ওয়াক্ফ স্টেইটের অংশীদার দক্ষিণবাজার জামে মসজিদ ২০১৮-২৩ পর্যন্ত মাত্র ৩৫০০ টাকা, কৌলা বড়বাড়ি মসজিদ ৩৫০০ টাকা অর্থ পেয়েছেন। ব্রাহ্মণবাজার জামে মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, আছরব আলী মোতাওয়াল্লী থাকাবস্থা থেকে এখন পর্যন্ত কোন সহায়তা মিলেনি। এছাড়া চৌধুরীবাজার জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিগত ১৫ বছর ধরে তারা ওয়াক্ফ থেকে কোন অনুদান পায়নি।
মোতাওয়াল্লি মাহবুবুর রহমান ইমন প্রবাসে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেয়া যায়নি। তবে তাঁর মাতা হুসনে আরা বেগম বলেন, নিয়ম মেনে সঠিকভাবে ওয়াক্ফ পরিচালনা করে যাচ্ছি। ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয় থেকে জমির খাজনা দিয়ে আসছি এবং ওয়াক্ফ মক্তবের ব্যয় দিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ওয়াক্ফ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জমির মাটি বিক্রি করে দুটি মাছের ফিসারি করেছি। দুটি ফিসারির মধ্যে একটি স্থানীয় আলাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে ৩ বছরের জন্য ৯০ হাজার টাকায় লিজ দেয়া হয়েছে এবং অপর ফিসারি ছালেক মিয়া নামে আরেক ব্যক্তিকে বছরে ৮০ হাজার টাকায় লিজ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মাটি বিক্রির টাকা দিয়ে পুকুর পাড় ও গার্ড ওয়াল তৈরি করেছি। ওয়াক্ফকৃত জমি কিভাবে বিক্রি হলো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জায়গা বিক্রির বিষয়ে তিনি অবগত নন।
ওয়াক্ফ মৌলভীবাজারের পরিদর্শক মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, সরেজমিন তদন্তে ছোয়াদ উল্লাহ ওয়াক্ফ এষ্টেট পরিচালনায় অনেক অসংগতি পাওয়া গেছে। পুকুর খননের জন্য মোতাওয়াল্লী আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন আমি উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাই। কিন্তু সেখান থেকে কোন অনুমোদন মেলেনি। অনুমতি না নিয়ে পুকুর খনন করা উচিত হয়নি। বর্তমান মোতাওয়াল্লী যদি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন তাহলে ভালো হতো। ওয়াক্ফ কিভাবে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা যায় সেই বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবো।
মন্তব্য করুন