বড়লেখায় শিক্ষক সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে ৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান
![](https://i0.wp.com/www.patakuri.com/wp-content/uploads/2024/02/22222.jpg?fit=800%2C445&ssl=1)
আব্দুর রব॥ বড়লেখা উপজেলার ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটে দেড় হাজার শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন পাঠদান কার্যক্রম মূখ থুবড়ে পড়েছে। শিক্ষক সংকট নিরসনের আবেদন করা হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষক সংকট দূর করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান নিশ্চিতের দাবি অভিভাবকসহ সচেতন মহলের।
বাংলাদেশ সরকারের নথি অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু এই ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা যেন পুরোপুরিই অনুপস্থিত।
চলিত বছর থেকে সব বিদ্যালয়কে এক শিফটে রূপান্তরের সরকারি পরিকল্পনা এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু হয়েছে যা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া উল্লেখ করে শিক্ষকরা জানান, অবকাঠামোগত সমস্যায় থাকা এবং ৪ শিক্ষক বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে এই প্রক্রিয়া (এক শিফটে বিদ্যালয় পরিচালনা) বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
চাহিদা থেকে কম শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা এবং যথাযথ পাঠদান খুবই কষ্টকর বলে জানিয়েছেন ভূক্তভোগী প্রধান শিক্ষকরা। এতে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষার মান দিনদিন নিম্নগামী হচ্ছে। ৬ কিংবা ৭ পদ বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের সাথে এই ৪ পদের বিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মানের বিশাল ফারাক। শুধু তাই নয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংখ্যা এবং দূরত্ব বিবেচনায় ডাবল শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালুর যে নির্দেশনা সরকার দিয়েছে তাও এখানে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
জানা গেছে, উপজেলার দাসেরবাজার ও নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নে ৩টি করে মোট ৬টি, তালিমপুর ইউনিয়নে ২টি এবং বর্ণি ইউনিয়নের ১টিসহ মোট ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থেকে ৪ জন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রায় এক বছর পূর্বে ভূক্তভোগী ৯ জন প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষরিত ও তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, এমপির সুপারিশসহ একটি আবেদন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মীর আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে জমা দিতে গেলে তিনি তা গ্রহন না করে দ্রুত শিক্ষক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় মোট ১৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষক সংকটে ভোগছে ৯টি বিদ্যালয়। সেগুলো হলো দাসেরবাজার ইউনিয়নের উত্তর বাগীরপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধর্মদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চান্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নের উত্তর মাইজগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুফিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাগাডহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালিমপুর ইউনিয়নের দ্বিতীয়ারদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বর্ণি ইউনিয়নের রংপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
উপজেলার একাধিক শিক্ষককের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, মানসম্মত শিক্ষাদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বড়লেখায় এখনো ৪ পদ বিশিষ্ট বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে নিয়মিত পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে। কোন একজন শিক্ষক ছুটি জনিত অনুপস্থিত কিংবা প্রধান শিক্ষককে দাপ্তরিক কাজে উপজেলা সদরে যেতে হলে পড়াশোনার মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সঠিক পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তারা আরো জানান, নতুন জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলো সবই ৬ শিক্ষক বিশিষ্ট। যার অনেকগুলোতেই শিক্ষার্থী সংখ্যা অল্প। যা অসামঞ্জস্য ও মান সম্মত শিক্ষা অর্জনের অন্তরায়। শিক্ষকদের বদলীর ক্ষেত্রেও চার শিক্ষক বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার। সব ধরনের ক্যাটাগরির বদলীর পর এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বদলীর সুযোগ পান। ফলে দেখা যায় তাদের কাঙ্খিত বিদ্যালয়ের পদ আগে থেকেই পুরণ হয়ে গেছে। তাছাড়াও বদলী হতে গেলে এসব বিদ্যালয় থেকে স্থলাভিসিক্ত শিক্ষক দিয়ে তারপর বদলী হতে হয়। ফলে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও একধরনের হতাশা বিরাজ করে। বদলী প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় এসব বিদ্যালয়ে কেউ যেতেও চায়না।
বড়লেখা উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বদরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডাবল শিফটের পরিবর্তে এক শিফটে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চাহিদার চাইতে কম শিক্ষক নিয়ে চলা স্কুলগুলো। দ্রুত সময়ের মধ্যে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন এই শিক্ষক নেতা।
শিক্ষক সংকটে থাকা উপজেলার ৯টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা বললে তারা জানান, শিক্ষক সংকটের কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। সব স্কুল ১ শিফটে পরিচালনার সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে তা বাস্তবভিত্তিক নয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা স্কুলগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। এতো রুম নেই যে এক শিফটে সবার জায়গা হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার দিক বিবেচনা করে সর্বাগ্রে শিক্ষক সংকট দুর করার জন্য তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান।
নিজের ইউনিয়নে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট নিয়ে দাসেরবাজার ইউপি চেয়ারম্যান স্বপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বিষয়টি আমার নলেজে ছিল না, তবে এখন জেনেছি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শিক্ষক সংকট দূর করার ব্যবস্থা নিতে কথা বলবেন।
এব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম জানান, সংকট নিরসনে সরকার কাজ করছে। যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মীর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে তার একটি তালিকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ইতিমধ্যে ১টিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোতে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষক সংকট নিরসনের প্রক্রিয়া চলছে।
মন্তব্য করুন