ব্যাপক ক্ষতি ধান,জলজ প্রাণি ও মৎস্য সম্পদের হাকালুকি হাওর তীরে শুধুই আহাজারি

April 23, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ সুনশান নীরবতা হাওর পাড়ে। ফসল হারানোর বেদনায় শোকাতুর চাষী পরিবার। হঠাৎ অপরিচত কাউকে দেখলে আৎকে উঠছেন। সরকারী কর্মকর্তা ভেবে জটলা বেঁধে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন। প্রত্যাশা এই দু:সময়ে একটু হলেও সরকারী সহায়তা পাওয়ার। ধান আর মাছ হারিয়ে এখন হাওর জুড়েই শোকের মাতম। সর্বগ্রাস করে এখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে হাওর। কিন্তু কান্না থামছেনা কৃষক ও জেলে পরিবারের। খাওয়া বাঁচার চিন্তায় তারা চরম হতাশ।সব হারিয়ে এখন দু চোখের অশ্রুই যেন তাদের সম্বল। ক্ষতিগ্রস্থদের বোবা কান্নায় ভারী হচ্ছে হাওর তীরের পরিবেশ। সর্বশ্রান্ত অসহায় মানুষ গুলোর আহাজারিতে দু চোখের জল ধরে রাখা কষ্ঠকর। জেলার কৃষি বিভাগের তথ্যমতে এবছর জেলায় বোরো চাষ হয়েছে ৫৩ হাজার ৪শ’২৬হেক্টর জমি। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৭হাজার ৪শ’৩২ হেক্টর।এর মধ্যে হকালুকির তীরবর্তী কুলাউড়া,জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১২ হাজার ৯শ’৩৫ হেক্টর বোরো ফসলের জমি। জেলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ৩০ হাজার ৮শ’ ৩০ জন কৃষক। আর সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমান ১শ’ ১৩ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা। হাওর জুড়ে মরেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। মরেছে শামুক, জোঁক,সাপ,ব্যঙ্গসহ নানা প্রাণী। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে হাকালুকি হাওরে ২৫ হাজার মেট্রিকটন মাছ মারা গেছে। এর মধ্যে কুলাউড়া অংশে ৮ ,জুড়ী অংশে ৭ ও বড়লেখা অংশে ১০ মেট্রিকটন মাছ মারা গেছে। কিন্তু কি পরিমান জলজ প্রাণির ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দূষিত পানিতে জীববৈচিত্রে ভরপুর হাকালুকিতে বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদের কোন ক্ষতি হয়েছে কি না। হলে কি পরিমান হয়েছে তা নিয়ে রয়েছেন উদ্বিগ্ন। এখনো হাওর থেকে আসছে উৎকট র্দূগন্ধ। অনেক দূর থেকে তা টের মিলছে। মাছ, হাঁস ও অনান্য জলজ প্রাণির মড়ক থামলেও এখনো কমছেনা মরা পচা দূর্গন্ধ। জলাবদ্ধতায় হাওরের বিবর্তিত হওয়া লাল ও কালছে পানির রং কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। জেলা মৎস্য বিভাগ পানির গুনগতমান ঠিক হয়েছে দাবী করলেও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি পানির গুনগতমান এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা। এখনো পানি হাতে নিলে র্দূগন্ধ হাতেই লেগে থাকছে। পানির গুনগত মান ফেরাতে চেষ্ঠা চলছে মৎস্য বিভাগের। তাদের এমন প্রচেষ্ঠা আর প্রকৃতির সহয়তায় অনেকটা সফলতা আছে ধীরে ধীরে। গেল ২ দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সহায়ক হচ্ছে। হাওরের তীরবর্তী কিছু এলাকায় তলিয়ে থাকা বোরো ধান জেগে উঠছে। কিন্তু এ নিয়ে কোন আগ্রহ নেই কৃষকের। কারণ থোড়ওলা ও আধাপাকা এই ধান গুলো দীর্ঘ দিন পানিতে ডুবে থাকায় চাল হওয়া তো  দূরের কথা পচা ধান গাছ গুলো গো মহিষের খাদ্যও হচ্ছেনা। এই সময় হাওর জুড়ে বোরো ফসল কাটা আর মাড়াইয়ের ধূম পড়ার কথা ছিল। নতুন ধান ঘরে তোলা নিয়ে আনন্দিত কৃষক পরিবার গুলো নবান্ন উৎসবে ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও উল্টো চিত্র।

এবছর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হঠাৎ ক’দিনের টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলের পানিতেই তাদের স্বপ্নের অপমৃত্যু। হাওরের ওপর নির্ভরশীল মৎস্য ও কৃষিজীবীদের ধান নেই মাছও নেই। মাথাগুজার ঠাঁইও গ্রাস করতে চায় থৈই থৈই পানি। একের পর এক দূর্যোগ। চোখের সামনেই বিলিন হচ্ছে সব। বোরো ধানের পর মাছ। মরেছে পোষা হাঁস আর জলজ প্রাণী। এক এক করে জীবন জীবীকার সব উপকরণ হারিয়ে নি:স্ব হাওর তীরের দরিদ্র লোকজন। হঠাৎ এমন দূর্যোগে দিশেহারা হাকালুকি হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবীরা। হেক্টরের পর হেক্টর সোনালী বোরো ফসল গ্রাস করেছে পানি। পানিতে ডুবে থাকা ওই পচা ধানই মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাছ ও জলজ প্রাণির। হাকালুকি হাওরে এমন ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই প্রথম। এর আগে এক সাথে এমন বড় বির্পযয় তারা কখনো দেখেনি। এমনটি বলছেন হাকালুকি হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্থরা। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে বাচাঁ মরার লড়াইয়ে এখন বিপর্যস্ত হাকালুকি হাওর পাড়ের মানুষ। পরিবারের জীবীকা চালানোর কোন উপকরনই আর অবশিষ্ট নেই। তাই চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। হাওরের তীরের মানুষের জীবন জীবীকা চলে বোরো ধান চাষ আর মাছ ধরে। কিন্তু এবছর তাদের দু’টি সম্পদই যে কেড়ে নিয়েছে চৈত্রের অকাল বৃষ্টির পানি আর পাহাড়ি ঢল। প্রতিনিয়ত বোরো চাষী আর জেলেরা হাওর তীরে বসে হাওরের এমন দৃশ্য দেখে আহাজারি করছেন। এখন হাওর জুড়ে বিশুদ্ধ পানি আর স্যানিটেশন হীনতার পাশাপাশি পানিবাহিত নানা রোগ ছড়ানোর উৎকন্ঠায় রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্ধারা। ইতিমধ্যেই গেল বছরের মজুদকৃত বোরো ধান চাল শেষ হয়ে গেছে তাদের। অভাব অনটনের জনবহুল পরিবার গুলোতে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। তিন বেলা ভাতের নিশ্চয়তার পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া,চিকিৎসা আর সংসার নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন জেলে ও চাষী পরিবার। অভাবের তাড়নায় আর খাদ্য ও বাসস্থান সংকটে বিক্রি করছেন গরু মহিষসহ পোষা প্রাণি। গতকাল সরজমিন হাকালুকি হাওরে গেলে হাওর পাড়ের মহেশগৌরির মো: লিচু মিয়া,মো: শামীম মিয়া,তৈমুছ আলী গড়করনের ছানা মিয়া সাদিপুরের কয়েছ আহমদ বটলাই,ফয়ছল মিয়া,নাসিম,আয়াছ আলী,হাবিজ আলীস সহ অনেকেই জানান চৈত্রের অকাল বন্যায় আমাদের সবশেষ। যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার ধান কৃষকের ঘরে উঠার কথা সে খানে উঠনি এক সেরও ধান। একেকটি পরিবারে ১০-১৫জন সদস্য তাদের খানি খোরাক হবে কি করে। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া চালাবো কি করে। এবছর সংসার চালাবো কি ভাবে। হাওর যে আমাদের ফতুর করে দিয়েছে। হাওর পাড়ের ইসলাম গঞ্জ ,মিরশংকর ও ঘাটের বাজারে কথা হয় মৎসজীবী সাদিপুর গ্রামের বাছির মিয়া,সুজাত মিয়া,আব্দুল মতলিব,সামরুল ইসলাম,দুদু মিয়া,মিরশংকরের কৃষিজীবী অজির আলী,বদর উদ্দিনসহ অনেকের সাথে। তারা হাওর দেখিয়ে ক্ষোভে দু:খে জানালেন ওই হাওরই এবছর আমাদের সর্বনাশ করেছে।ধান,মাছ,হাঁস,আর জলজ প্রাণি খেয়ে তার পেট ভরেছে। শূন্য হাওর থেকে আমাদের জীবন জীবীকা চলবে কি করে। মহাজন ও এনজিও সংস্থার কাছ থেকে আগাম ঋণ নিয়ে বোরো চাষ করেছিলাম। ভেবে ছিলাম ফসল ঘরে তুললেই ঋণ পরিশোধ করব। এবছর বাম্পার ফলনও হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিই আমাদের হাওরের সব কেড়ে নিয়ে নিল। পাওনাদাররা তাগিদ দিচ্ছেন। কি করব ভিটে মাটি বিক্রি করা ছাড়া যে আর কোন সম্পদ নেই। তারা সরকারের কাছে এ অঞ্চলকে দূর্গত এলাকা ঘোষণার দাবী জানান।


হাওরের তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এবছর অকাল বন্যায় ধানের পচনে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে ডিমওয়ালা মা মাছ, পোনা মাছ, হাঁস ও জলজ প্রাণির মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজননের হাওরটি হুমকির মুখে পড়ছে। হাকালুকির বিল ইজারাদার আনোয়ার হোসেন,আব্দুর রব কামাল,সমছির আলী সহ অনেকেই জানান বিল গুলোতে সরকারের রাজস্বসহ প্রায় কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা। বিল গুলোর সব মাছ মরে সাফ। কি করে ক্ষতি পোষাবেন তা ভেবে দিশেহারা। এদিকে হাকালুকিতে ৩ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। বাজার গুলোতে যেমন কম মাছ উঠছে তেমনি দামও চওড়া। তাছাড়া রোগ জীবাণুর ভয়ে মাছের ক্রেতাও কমে গেছে বলে জানালেন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকার্তা আ.ক.ম শফিক-উজ-জামান ও সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো: সুলতান মাহমুদ জানান দু’দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি আর মৎস্য বিভাগ চুন ছিটানোতে হাওরের পানির স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। ৮টি বিলে  ১৮ লক্ষ পোনা নার্সিং করা হচ্ছে জুনের আগে পোনা গুলো অবমুক্ত করা হবে। পোনা মাছ ছেড়ে হাকালুকি হাওরের মাছের ক্ষতি পোষানোর চেষ্ঠা অব্যাহত থাকবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো: শাহাজান বলেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিচ্ছে কৃষিবিভাগ। ক্ষতি পোষিয়ে উঠতে এবছর আউশ ধান চাষে অনাবাদি ৫ হাজার হেক্টর জমি চাষের আওতায় আনা হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com