মৌলভীবাজারে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা অনুষ্ঠিত : জুয়া, যাত্রা ও পুতুল নাচের নামে উলঙ্গ নৃত্য হয়নি

January 14, 2017,

এস এম উমেদ আলী ॥ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে ৩ দিন ব্যাপী এ মেলায় দেশীয় প্রজাতির ফরমালিনমুক্ত মাছ কিনতে বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন ক্রেতারা ভীর জমান। কিনে নিয়ে যান হাওর ও নদীতে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা পচন্দের মাছ। শনিবার সন্ধ্যায়। জেলার সীমানা ঘেষে তিন জেলার মিলন স্থল শেরপুর এলাকায় বসে মাছের মেলা।

সংক্রান্তি উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে তৈরী হয় নানা ধরনের পিঠা পুলি ও সুস্বাদু খাবার। তার একটি বড় অংশ হচ্ছে বাজার থেকে বড় আকারের মাছ কিনে খাবার তৈরী করা।
স্থানীয়দের প্রতিবাদে এ বছর প্রশাসন মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে জুয়া, যাত্রা ও পুতুল নাচের নামে উলঙ্গ নৃত্য সহ সকল ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ করতে দেয়নি। এতে করে মেলায় শুধু বেচা-কেনা হয় মাছ, ফিরে আসে মাছের মেলার মূল ঐতিয্য।
সদর উপজেলার শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় দুইশত বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে এ মাছের মেলা। মেলাস্থল শেরপুর হলো মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার একেবারেই শেষভাগে। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাছের মেলাটি শুরু হলে এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার ১২ জানুয়ারি রাত থেকে শুরু হয়েছে তিনদিন ব্যাপী এই মেলা শেষ হয়েছে শনিবার সন্ধ্যায়। জেলার সীমানা ঘেষে তিন জেলার মিলন স্থল শেরপুর এলাকায় বসে মাছের মেলা।

বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ নিতে আসা একাধিক ক্রেতারা জানান দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ পাওয়ায় তারা কিনতে আসেন এ মেলায়। তবে মাছের মুল্য গত বছরের চেয়ে কয়েক গুন বেড়ে গেছে বলে মাছ কিনতে আসা ক্রেতা মৌলভীবাজার পৌর এলাকার দরগা মহল্লার সালেহ আহমদ, সিলেট শহরের মোঃ আব্দুল্লাহ ও আইন পুরের হাজী সাবু মিয়া ও দিপলু মিয়া, নবীগঞ্জের অনিল দাশ সহ অনেকেই জানান, বাজারে প্রচুর মাছ উঠলে বিক্রেতারা দাম বেশি চাচ্ছেন। দৈনান্দিন বাজারের যে মূল্যে মাছ বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশী দামে কিনতে হয় মেলা থেকে মাছ।
বাংলাদেশের বিভন্নি এলাকা থেকে আসা মৎস ব্যবসায়িরা চারপাশের ডালায় সাজিয়ে বসে রয়েছেন। মাছ কিনতে আসা হাজারো মানুষের ভিড় নেমেছে এ মেলায়। এখানে শুধু মাছ কিনতে সবাই আসেনি। অনেকে এসেছে মাছ দেখতে।
স্থানীয় মাছ বিক্রেতা মোঃ শওকত আলী রহিম উদ্দিন জানান হাওর ও নদীতে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা মাছ সাধারণত তারা নিয়ে আসেন এই মেলায়। মেলা উপলক্ষে মাছের চাহিদা কয়েকগুন বেড়ে যায় এবং মাছের সংগ্রহ কমে যাওয়ায় মূল্য কিছুটা এই সময়ে বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মেলায় দোকান ভাড়া ৩ দিনের জন্য ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। এ দিকে সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী মোঃ আছের আলী জানান যমুনা নদী থেকে মিনি ট্রাক ভর্তি করে দেশীয় প্রজাতির বোয়াল মাছ, আইর মাছ ও বাগমাছ নিয়ে আসেন মেলায়, নিমিশেই মাছ শেষ হয়ে যায়।
মেলায় আসা বিভিন্ন পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুয়ায়ী প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় মেলায়। আর সমাগম ঘটে দেশের নানা প্রান্তের ভোজনবিলাসী লক্ষাধিক মানুষের।
কুশিয়ারা নদী, সুরমা নদী, মনু নদী, হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন বিল, টাঙ্গুয়ার হাওর, কাওয়াদিঘি হাওর, হাইল হাওরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, বাঘ, আইড় মাছসহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন এ মেলায়।
আগে এই মাছের মেলায় স্থানীয় বিভিন্ন হাওর-বাওরের, নদ-নদীর মাছ নিয়ে আসতো জেলেরা। এখন মৎস্য খামারগুলোর মাছতো আসেই। আসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীদের বিরাট বিরাট চালান।
মৎস্য ব্যবসায়ি জালাল মিয়া জানান, পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলার নবিগঞ্জ উপজেলা, উত্তরে কুশিয়ারা ও সিলেট জেলার বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর উপজেলা মৎস্য ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বৃহৎ মাছের মেলা এটি। যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত, মাছ ছাড়াও বিভিন্ন কয়েক হাজার দোকান বসে কুশিয়ারার তীর জুড়ে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।
মেলায় মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থলী সামগ্রী, খেলনা সামগ্রী, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের দোকানও স্থান পায়। এছাড়া শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষকে মাতিয়ে তোলার জন্য রয়েছে বায়োস্কোপ ও চড়কি খেলা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, চলতি বছর ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকায় মেলা ইজারা নেন তপু ভৌমিক। গত বছর মাছের মেলা ১৬ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা যায়। এ বছর মাছের মেলার অন্তরালে জুয়া, যাত্রা ও পুতুল নাচের নামে উলঙ্গ নৃত্য সহ অসামাজিক কার্যকলাপ পূর্ব থেকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ থেকে নিষিদ্ধ জানানো হলে ইজারা মূল্য কমে আসে।
মেলায় মাছের মূল্য ৫শ টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা মূলের মাছ উঠেছে। বর্তমানে এই মাছের মেলা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মিলনমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com