মৌলভীবাজারে কুরবানির চামড়ার দাম নিয়ে কুরবানিদাতাসহ খুচরা ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের হতাশা

June 30, 2023,

মোঃ সালেহ আহমদ (লিপক) চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রধান মৌসুম পবিত্র ঈদুল আদ্বহা।

গত বছরের ন্যায় এবারও ঈদের প্রথম ৭ দিন ঢাকায় কোরবানির পশুর কোন চামড়া প্রবেশ করতে পারবে না। সেজন্য অন্তর্র্বতীকালীন কোরবানিকৃত পশুর কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য চামড়ায় লেগে থাকা মাংস ও চর্বি পরিষ্কার করে প্রয়োজনীয় পরিমান লবণ মাখিয়ে পক্রিয়াজাত করনের কাজ করে যাচ্ছেন মৌলভীবাজারের সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণ।

মৌলভীবাজারের প্রান্তিক ব্যবসায়ী তথা ফড়িয়ারা প্রতিবছর কোরবানি ঈদের মৌসুমে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন সেগুলো মনু নদীর তীর ঘেঁষা ঐতিহ্যবাহী বালিকান্দি চামড়ার বাজারে কিছুটা লাভে বিক্রি করতেন।

ব্যবসা করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে অনেক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ করেন তারা। লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়ার দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন কোরবানিদাতারাও।

আর ছাগলের চামড়ার কোন ক্রেতাই নেই। অনেকেই তা ফেলে দিচ্ছে ড্রাস্টবিনে কিংবা পুঁতে ফেলছেন মাটিতে। এমন অবস্থা বিরাজ করেছে প্রবাসী অধুষ্যিত মৌলভীবাজার জেলায় কুরবানি পরবতী চামড়ার ব্যবসায়।

মৌলভীবাজারে এবছর প্রায় ৮০ হাজার কুরবানির পশুর চাহিদা ছিলো। শেষ মূহুর্তে এসে চাহিদা পূরণ হলেও কুরবানির চামড়া নিয়ে চরম হতাশা বিরাজ করছে কুরবানিদাতা থেকে শুরু করে সাধারণ খুচরা ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের মাঝে।

অপরদিকে লাভবান হচ্ছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। তারা বেশি দাম দিয়ে চামড়া কিনতে নারাজ। ফলে অনেকে হতাশ হয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন খাল বিল ও নদীতে। মৌলভীবাজার অন্যতম চামড়ার ব্যবসায়ী এলাকা বালিকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।

কুরবানির পর সারা জেলা থেকে চামড়া মজুত হয় এই গ্রামে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ফড়িয়া, খুচরা ব্যবসায়ী এবং এতিমখানা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ গরুর চামড়া নিয়ে আসেন বালিকান্দিতে।

লাখ টাকায় ক্রয় করা গরুর চামড়া সেখানে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৩শ টাকায়। অথচ বিক্রেতারা পাচ্ছেন না সরকার নির্ধারিত দাম।

বৃহস্পতিবার ২৯ জুন ঈদের দিন বিকেলে কথা হয় বালিকান্দি গ্রামের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মুহিব মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৫০ পিছ কিনেছি। দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকার মধ্যে।

দেখা যাক কত বিক্রি করতে পারি। সংগ্রহের জন্য ১টা গাড়ি ভাড়া নিয়েছি আড়াই হাজার টাকা দিয়ে। আরো আনুষঙ্গিক খরচাদি আছে। এরপরে লাভের হিসাব।

বালিকান্দি গ্রামের পাইকার সুলেমান মিয়া বলেন, এখনও কিনতে পারছি না। দাম বেশি চাচ্ছে ফড়িয়ারা। আমরাও কিছু লাভ করতে হবে। যে অবস্থা, ২০-৩০ টাকা থাকতে পারে প্রতি পিছে। দামের সময় ২’শ-৩’শ টাকা লাভ হতো। ৯’শ টাকা লবনের বস্তা এখন। যা আগে ৪’শ-৫’শ টাকা ছিল।

পৌর বাসটার্মিনালে কথা হয় ফড়িয়া হারুন মিয়া সঙ্গে। তিনি বলেন, কিনেছি পিছ ৪শ টাকা দিয়ে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কত বিক্রি করতে পারি।

আমতৈলের ফড়িয়া আব্দুল হক বলেন, ৩শ টাকা করে পিছ কিনেছি। গাড়িভাড়া দিয়ে নিয়ে এসেছি। বাজারের যে অবস্থা, জানিনা কি হবে।

ফড়িয়া রফিক মিয়া বলেন, দাম চাচ্ছি পিছ ৬শ টাকা করে। ৫ খানার দাম ১ হাজার টাকা করছেন এক পাইকার। আগে ১৫/১৬শ টাকা পিছ বিক্রি হতো। বলিয়ারভাগের ফড়িয়া আবুল বলেন, ৪শ টাকা করে পিছ কিনেছি, ৬শ টাকা করে বিক্রি করতে চাই।

মদিনাতুল মহিলা মাদরাসার শিক্ষক মাওঃ মোঃ লিয়াকত আলীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, যেভাবে আশাবাদী ছিলাম এখন দেখছি সেরকম নয়। ২শ টাকা করে পিছ দাম হয়েছে। ৪শ পাইলে বিক্রি করবো।

মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সামনে কথা হয় ফড়িয়া মোঃ খোকন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, পিছ কিনেছি আড়াই শ টাকা করে। বিক্রি করেছি ৩শ টাকায়। একটু পরে কাচা চামড়া কেউ নিতে চাইবে না।

তাই বিক্রি করে ফেলেছি। তিনি বলেন, সরকারি রেইটে বিক্রি করতে হলে পক্রিয়াজাত করতে হয়। একপিছ চামড়ায় ১০/১২ কেজি লবন লাগে। পক্রিয়াজাত করা হয় বালিকান্দিতে। তারা মোটামুটি ভালো দাম পায়।

মৌলভীবাজার দারুল উলুম টাইটেল মাদ্রাসায় গিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক পৌর কাউন্সিলর আলহাজ্ব মোঃ আয়াছ আহমদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে ৫শ এর বেশি চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে।

তিনি আশা করেন রাত ১০টার ভেতর আরো শতাধিক চামড়া সংগ্রহ হবে। গত বছরের তুলনায় এবার একটু বেশি দাম পাওয়া যাবে বলেও তিনি মনে করেন। ৪শ টাকা পিছ দাম হচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে তারা চাচ্ছেন পিছ ৫/৬শ টাকা।

পশ্চিম শহরতলী জুগিডহরে হযরত শাহ্ খোয়াজ (রহ.) এতিমখানায় গিয়ে কথা হয় আহমেদ হোসাইন রুহেলের সাথে। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করেছি। এখনো চামড়া আসছে। আশা করি এ বছর ভালো দাম পাওয়া যাবে।

বিভিন্ন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, প্রান্তিক ব্যবসায়ী এবং পাইকারদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, মূল পুঁজি ওঠা তো দূরের কথা, প্রক্রিয়াজাত করনের লবণ ও পরিবহন খরচই উঠবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহাতীত তারা। চামড়ার ব্যবসা এখন পুরোটাই সিন্ডিকেটের হাতে।

প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা এখন জিম্মি। সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে ধ্বংস হয়ে যাবে এ খাত। অনেকেই আর চামড়ার ব্যবসা করবেন না বলেও জানান।

চামড়ার বাজারকে একটি চক্র নিয়ন্ত্রন করার ফলে ৪শ টাকায় চামড়া কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে দেড়শ টাকায়। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা এর চেয়ে বেশি দাম দিতে নারাজ। বড় সাইজের গরু থেকে মাজারি সাইজের গরুর চামড়া প্রতি দেড়শ থেকে ৩শ টাকা দাম ধরা হচ্ছে।

অথচ সেই চামড়া প্রকৃত দামে বিক্রি করলে চারগুণ বেশী দাম হওয়ার কথা। কিন্তু তারা সেটি পাচ্ছেন না। আর ছাগলের চামড়াতো কেউ কিনছে না। ফলে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ ফেলে দিচ্ছেন নদীতে বা মাটিতে পুঁতে ফেলছেন।

কুরবানিদাতারা পশুর চামড়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশ চামড়া এতিমখানায় দিয়ে দিচ্ছেন। আর এতিমখানা কর্তৃপক্ষ সেই চামড়া বালিকান্দিতে এনে বিক্রি করতে গিয়ে মৌসুমী সিন্ডিকেটদের কারণে নামমাত্র দাম পাচ্ছেনা।

চামড়া প্রক্রিয়াকাজাত কাজে নিয়েজিত কয়েকজন জানান, যেহেতু চামড়া কিনে আবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হয়। লবণের দাম ট্রান্সপোর্ট খরচ সবকিছু বাড়তি। তাছাড়া চামড়া নষ্ট না হওয়ার জন্য লবণ দিয়ে রাখতে হয়।

আবার সেটা ঢাকাতে পাঠাতে গিয়ে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। ফলে ট্যানারি পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়ে যে খরচ সেটি তোলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তৃণমূল পর্যায় থেকে কম দামেই চামড়া কিনতে হয়।

চামড়া ব্যবসায় এমন মৌসুমী সিন্ডিকেট এবং দাম না উঠা নিয়ে প্রশাসনের জরুরি ভিত্তিতে মনিটরিং এর প্রয়োজন। সরকারের বেধে দেয়া দাম অনুযায়ী চামড়া বিক্রি করতে হবে।

কেউ সেটা না করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। চামড়া খাতের উন্নয়নে সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঈদের দিবাগত রাতে মৌলভীবাজার জেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের মনু নদীর তীর ঘেঁষা বালিকান্দি চামড়ার বাজারে চামড়া পরিষ্কার করে লবণ মাখানোর কাজ পরিদর্শন ও তদারকি করেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com