মৌলভীবাজারে জেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নেতাদের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুঁরি

December 27, 2016,

বিশেষ প্রতিনিধি॥ এক ভোটের মূল্য এক লাখ টাকা। একজন ভোটারের রয়েছে ৩টি ভোট। বাকী দু’টো ভোটের মূল্য ৫০ হাজার টাকা। একজন ভোটার পাচ্ছেন গড়ে দেড় লাখ টাকা। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে মৌলভীবাজারে জেলা পরিষদ নির্বাচনে। এখানে ভোটারদের কদর এখন আকাশচুম্বী।
২৮ ডিসেম্বর বধুবার সকাল থেকে নির্বাচন। আনুষ্ঠানিক প্রচারনা শেষ হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর সোমবার রাতে। আজ দিনে রাতে চলবে গোপন লেনদেন। আর এ সুবাধে ভোটের মূল্যও বাড়ছে হু-হু করে। এই নির্বাচনে একটি ভোট যেন একটি সোনার হরিন। তাই জয় পরাজয়ে এখন চলছে ভোটের চূড়ান্ত হিসাব-নিকেশ। প্রচারণার শেষ মুহুর্তে এসে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে প্রার্থীরা দেদারসে টাকা বিলিয়ে দিচ্ছেন। তবে জেলার ১৫টি ওয়ার্ডের সব কটিতে এমন চিত্র বলা যাবেনা। যেসব ওয়ার্ডে প্রবাসীরা নির্বাচন করছেন সেখানে চলছে টাকার খেলা। এ জেলায় চেয়ারম্যান পদে মৌলভীবাজারে আ’লীগের ৩ প্রার্থী (দুজন বিদ্রোহী) বিএনপির একজনসহ অন্যান্য আরো দুই প্রার্থী। আ’লীগের ৩ প্রার্থী থাকায় ব্যয়ভার প্রচুর বেড়েছে বলে জানা গেছে।
চেয়ারম্যান পদে অন্যান্য প্রার্থীরা টাকা ছাড়লেও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রতিটি উপজেলায় টাকার বদলে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা ভোটারদের সমানতালে দিয়ে চলেছেন প্রজেক্ট দেয়ার ফুলঝুঁরি। ভোটার প্রতি প্রজেক্ট দেয়ার ফুলঝুঁরিতে এবার চিরে ভিজবেনা বলে অনেক ভোটার জানালেন। নির্বাচনের পরে সবাইকে যদি প্রজেক্ট দিতে পারা যায় তাহলে বিগত ৫ বছরের প্রজেক্টগুলো গেলো কোথায়? আওয়ামীলীগের ২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন সাবেক এমপি এম এম শাহিন। অনেক সচেতন ভোটার জানালেন নিজেদের আখের গোচাতে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে থেকে এম এম শাহীনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন সাবেক এমপিরা। এম এম শাহিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি আর যেহেতু প্রার্থী হবেন না সেহেতু সাবেক এমপিরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এম এম শাহীনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এ জেলায় অর্ধেকের বেশী বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান মেম্বাররা রয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে সিংহভাগ ভোট পেতে পারেন এম এম শাহীন। তাছাড়া আওয়ামীলীগের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছাড়াও সাবেক সমাজকল্যানমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর সমর্থরা কোনভাবেই চাইছেননা সাবেক চীফ হুইপ গ্রুপের কেউ চেয়ারম্যান হোক। সৈয়দ মহসীন আলী বলয়ের অনেকটা ভোট পাবেন এম এম শাহীন এমনটা জানালেন সচেতন ভোটাররা।
শেষ মুহুর্তে এসে কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ছাড়াও সদস্য প্রার্থীরা সমান তালে চালাচ্ছেন ভোট ক্রয় কার্যক্রম। এতে ভোটারা যেমন খুশি হচ্ছেন তেমনি অনেক ভোটারও হচ্ছেন বিব্রত। তবে ভোটের জন্য এ টাকা লেন দেনের কাজ চলছে খুব সুক্ষভাবে। সবার অগোচরে প্রার্থী আর ভোটারের বিশ্বস্ত মাধ্যমে। এখন এমন অতি গোপনীয় লেনদেনের বিষয়টি চাউর হচ্ছে জেলা জুড়ে সর্বমহলে। এর কারণ কোন কোন প্রার্থী লেনদেনে এতটুকু অগ্রসর হয়েছেন এখন অনেকটা বেপরোয়া ভাবে ভোটারকে সরাসরিই অফার করছেন। জুট ঝামেলায় না গিয়ে ভোটের মূল্য জানতে চাইছেন। এতে অনেক ভোটার ক্ষোভ ও অপমানে বিষয়টি নিয়ে তার সহকর্মী বা নিকটজনকে খুব সাবধানে বললেও পরে তা একান থেকে ওকানে হয়ে যাচ্ছে সবার মুখে মুখে। নির্বাচনের দিনক্ষন এগিয়ে আসায় এখন প্রার্থী ও অধিকাংশ ভোটারদের মধ্যে এমন মনোভাবই কাজ করছে। ‘বড় লোকের বড় নির্বাচন টাকা ছাড়া জেতা যায় না ইলেকশন’। কয়েকজন ইউপি সদস্যের কাছে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে জানতে চাইলে তারা প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ভাই এটা সত্য এই নির্বাচনে কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী যেমন টাকা দিয়ে ভোট কিনছেন তেমনি সদস্য প্রার্থীরাও একই কায়দায় ভোট ক্রয়ের চেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা যেমন কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার ভোটারকে নানা ভাবে ম্যানেজ করে (টাকা দিয়ে ভোট কিনে) এ জায়গায় এসেছি আর এই নির্বাচনে ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি এর পেছনে কি ছিল। তারা প্রশ্ন রেখে আবার রসিকথায় উত্তরে জানালেন টাকা। আমরা যখন টাকা দিয়ে ওখানে এসেছি তাহলে উনারাও টাকা ছাড়া কিভাবে আমাদের ভোট পাবে। তারা বলেন ভাই ওরা নির্বাচিত হলে আমাদের মত তাদের এত দ্বায়বদ্ধতা থাকবেনা। কারণ আমাদের মত তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কাজ থাকবে না। আর নির্বাচিত হলে উনাদের কাছে আমরাও ভিড়তে পারব না এমনটিই রীতি। তাই আমাদের মত অনেকেই এই সুযোগ হাত ছাড়া করছেন না। তারা স্বীকার করে বলেন যদিও কাজটি ঠিক হচ্ছে না কিন্তু এমনটিই নির্বাচনী রেওয়াজ। এটাই হলো নির্বাচনী ব্যয়ের অন্যতম খাত। যতই হলফ নামায় ব্যয়ের খাত লিখেন এটাই কিন্তু অলিখিত ব্যয়ের খাত। তারা জানালেন নির্বাচনী আগের রাত পর্যন্ত চলবে এমন ভোট কেনা বেচার লেনদেন। যে যত বেশী টাকা দিবে শেষমেষ তাকেই বিবেকের তাড়নায় ভোট দেবেন তারা। এক্ষেত্রে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি সদস্যদের চাইতে চেয়ারম্যানদের টাকার ডিমান্ড বেশী বলে তারা জানালেন। তবে সব প্রার্থী যে টাকা দিচ্ছেন এমনটি যেমন সঠিক নয় তেমনি সব ভোটারাও যে টাকা খাচ্ছেন সেটিও ঠিক নয়।
দু’জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর ঘনিষ্টজন ও নির্বাচনী ব্যয় দেখভালের দ্বায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সাথে আলাপে প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পরে জানা গেল ভোটের জন্য ভোটারদেরকে চা নাস্তার টাকা দিচ্ছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর ঘনিষ্ট ব্যক্তি জানালেন নির্বাচনে ভোট না দিয়ে যাতে ওই প্রার্থীর টাকা হাতিয়ে না নিতে পারেন এ জন্য আগে ভোটের বায়না (অগ্রিম) অর্ধেক টাকা দিচ্ছেন চুক্তি করে। আর বাকি টাকা নির্বাচনে ওই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সিলযুক্ত ব্যালেটের ছবি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে নিয়ে এসে দেখালেই চুক্তির বাকী টাকা সাথে সাথে লোক মারফতে করা হবে পরিশোধ। প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে প্রার্থীরা ভোটারদের টাকাদানে এমন অভিনব পদ্বতি অবলম্বন করছেন। প্রার্থী ও ভোটারদের এমন অভিনব পদ্বতিতে ভোট ক্রয় বিক্রয়ের মনোভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের মাধ্যমে এ জেলার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সুশীল সমাজ ও সচেতন মহলে। তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে সর্তক হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। জেলা নির্বাচন অফিস সুত্রে জানা যায় মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৬ জন, সাধারন সদস্য পদে ৮৬ ও সংরক্ষিত (মহিলা) সদস্য পদে ২২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। নির্বাচনে ২১ পদে মোট ১১৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন। ৬৭টি ইউনিয়ন, ৫টি পৌরসভায় ও ৭টি উপজেলায় মোট (নির্বাচকমন্ডলীর সদস্য) ভোটার ৯৫৬ জন। জেলার ৭টি উপজেলার ১৫টি ওয়ার্ডে ১৫টি কেন্দ্রে ২৮ ডিসেম্বর ভোটাররা তাদের মূল্যবান ভোট প্রদান করবেন।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর জেলা সভাপতি ডাঃ সাদিক আহমদ বলেন, প্রার্থী ও ভোটারদের সেবা দেওয়া ও পাওয়ার মনোভাবে এগুলো পরিহার করা উচিত। ভোটে নাগরীকদের গনতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নে সৎ ও যোগ্যপ্রার্থী নির্বাচনে টাকা যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় এজন্য তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ তোফায়েল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভোটের জন্য আর্থিক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পাইনি। তবে মুঠোফোনে বা অনান্য মাধ্যমে যেটি জানতে পেরেছি যে ভোটের দিন মুঠোফোনের ক্যামেরায় সিলযুক্ত ব্যালেটের ছবি ভোটাররা প্রার্থীদের দেখাবেন সে সুযোগ থাকবেনা। আমরা প্রয়োজন হলে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে ভোট কেন্দ্রে ভোটার প্রবেশ করাব। এই অভিযোগ ছাড়াও যদি অনান্য কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তা হলে প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com