মৌলভীবাজারে দু’টি জঙ্গি আস্তানায় রুদ্ধশাস ৮২ ঘন্টা অভিযান নিহত ১০

April 4, 2017,

ইমাদ উদ দীন॥ দু’টি জঙ্গি আস্তানায় রুদ্ধশাস অভিযান চলে ৮২ ঘন্টা। বৈরী আবহাওয়া আর রাতে আলোস্বল্পতায় কৌশলগত কারনেই থেমে থেমে চলে এই অভিযান।
৩০ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেলে শেষ হয় অপারেশন “হিট ব্যাক”।আর শনিবার দুপুরে সমাপ্ত হয়‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’। অপারেশন শেষে ঘটনাস্থলে ফরেনসিক কাজ করছে ক্রাইম সিন ইউনিট। বাড়ি দুটি এখনো কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরাও করে রেখেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। আস্তানা দু’টিতে অভিযান শেষ হওয়ায় দীর্ঘ সময় উদ্বেগ উৎকন্ঠার পর এখন অনেকটা স্বস্তিতে জেলাবাসী। অভিযান শেষে দুই জঙ্গি আস্তানায় মিলেছে ১০ টি মরদেহ। নাসিরপুরে অপারেশন হিটব্যাক এর পর জঙ্গি আস্তানার ওই বাড়িতে মিলে সাত জনের ছিন্ন ভিন্ন দেহ। তন্মেধ্যে রয়েছে ১ থেকে ১২ বছর বয়সের ৪টি শিশু, ২ জন মহিলা যাদের বয়স (৩০, ৫০) ও ১জন পুরুষ (৩৮) বছর বয়স বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর মৌলভীবাজার শহরের বড়হাটের অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ এ নিহতের সংখ্যা ৩ জন। তন্মেধ্যে ২জন পুরুষ ও একজন মহিলা। অপারেশন “হিট ব্যাক” ও ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ নিয়ে টানা তিন দিন নানা কৌতুহল আর উদ্বেগ উৎকন্ঠায় উদ্বিগ্ন ছিলেন প্রবাসী অধ্যুষিত শান্তি প্রিয় এ জেলার মানুষ। আর দেশবাসীর কৌতুহলী প্রতিক্ষার সাথে এ জেলার প্রবাসীদেরও উৎকন্ঠার শেষ ছিলনা।বন্ধীদশায় ছিলেন জঙ্গি আস্তানা এলাকার বাসিন্ধারা। পুলিশি নিরাপত্তার কারনে জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ ব্যাবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে অনান্য উপজেলার।
মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে নিরাপত্তা জনিত বাড়তি সতর্কতার কারনেই এমন দূর্ভোগ। অভিযানের কারণে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকায় ওই এলাকার ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় বাসিন্ধাদের ভোগান্তির অন্ত ছিলনা। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত আস্তানা দু’টিতে পৌঁছা পর্যন্ত বুধবার ভোর থেকে র‌্যাব,পুলিশ,গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘিরে রাখে ওই জঙ্গি আস্তানা দুটি। তাদের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির কারণে ওই বাড়ি দুটির আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্দিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনির বাহিরে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। সিলেটের আতিয়ার মহলের ঘটনার পর থেকে এখানকার ঘটনাস্থলের বাহিরের নিরাপত্তার বিষয়টিও ছিল জোরদার। সর্বত্র এমন বাড়তি নিরাপত্তার কারনেই অনাকাঙ্খিত হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায় সিলেটের আতীয়ার মহল ও চট্রগ্রামের সিতাকুন্ডের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রাথমিক অভিযানে নিশ্চিত হয় জঙ্গি আস্তানার। প্রথমে বড়হাটের ওই বাড়িটি জঙ্গি আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত হলেও ওখানে অভিযানে পর তথ্য মিলে একই মালিকের গ্রামের বাড়িতেও ভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়ছে জঙ্গিরা। উভয় বাড়ির মালিক নাসিরপুরের মৃত আছদ্দর লন্ডনীর ছেলে লন্ডন প্রবাসী সাইফুল ইসলাম (সাইফুর)। পৌর শহরের বড়হাটের ওই বাড়ি থেকে নাসিরপুরের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার।
বুধবার বিকেলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত জঙ্গি আস্তানা দু’টিতে পৌঁছার পর রেকি করে। এরপর তারা নাসিরপুরের বাড়িতে অভিযান শুরু করে। বুধবার সন্ধ্যায় ঘন্টা-দেড় ঘন্টা অভিযানের পর আলো স্বল্পতায় রাতের বেলায় অভিযান বন্ধ রাখা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে প্রবল ঝড় বৃষ্টির কারণে অভিযান শুরু করতে বিলম্ব হয়। ১০টার দিকে অভিযান শুরু হলে ২টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। এ সময় নাসিরপুরের ওই বাড়ি থেকে ২-৩ কিলোমিটার দূরে বিভিন্ন স্থানে ওই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলির উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভীড় ছিল লক্ষ্যণীয়। নিরাপদ দূরে থেকে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় তারা অভিযান প্রত্যক্ষ করছিলেন। তাদের এলাকা জঙ্গি কলঙ্ক গোছাতে অনেকেই নানা ভাবে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন। অভিযান শেষে ওই দিন বিকেল ৫টায় ঘটনাস্থলের পাশেই মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়ন কমপ্লেক্সে প্রেস বিফিং করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। প্রেস বিফিংয়ে মনিররুল ইসলাম জানান বুধবার সন্ধ্যায় সোয়াতের অভিযানের শুরুতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গিরা সপরিবারে মৃত্যু বরণ করে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখে তারা অনুমান করছেন নিহতের সংখ্যা ৭-৮জন হবে। এর মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। প্রেস বিফিংয়ে কালে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান,কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের ডিসি প্রলয় কুমার র্জোয়ারদার। সিলেটের এডিশনাল ডিআইজি নজরুল ইসলাম,মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল ও অন্যান্য সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। মনিরুল ইসলাম জানান,মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় ড্রোন ব্যবহার করে আইইডি ও অন্যান্য বিস্ফোরক শনাক্ত করেন সোয়াট টিমের সদস্যরা।পরে প্রবেশ পথসহ বিভিন্ন স্থানে রাখা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও বোমা নিস্ক্রিয় করে ভেতরে প্রবেশ করে সোয়াত টিম। নাসিরপুরে নিহত জঙ্গিরা নব্য জেএমবি বলেও ধারণা করছেন তারা। তিনি বলেন, আতিয়ামহলে অভিযানের সময় সংঘটিত জোড়া বিস্ফোরণের সূত্র ধরেই কাউন্টার টেরোরিজম এর গোয়েন্দারা এই আস্তানার সন্ধান পায়। নাসিরপুরের এই আস্তানাটিকে জঙ্গিরা নিজেদের ‘হাইডআউট’ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলো বলে জানান। গ্রামীণ জঙ্গি আস্তানার মধ্যে সিলেট বিভাগেই এটিই প্রথম। তবে ঘটনার সাথে সিলেটের আতীয়ার মহল,চট্রগ্রামের সিতাকুন্ড ও বিমানবন্দর এলাকার আত্মঘাতী বোমা বহনকারী যুবকের বোমার সাথে ওখানের বোমার মিল রয়েছে।
অপারেশন ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’
নাসিরপুরের অভিযান শেষ হওয়ার পর সোয়াট টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে মৌলভীবাজার পৌরশহরের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের প্রস্তুতি নেন। মঙ্গলবার রাত থেকে আস্তানাটি পুলিশ ঘিরে রাখলেও বুধবার বিকেলে থেকেই র‌্যাব,পুলিশ ও অনান্যবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ ক্রাইম রেসপন্স টিমের (সিআরটি) সদস্যরা বড়হাটের জঙ্গি আস্তানার জঙ্গিদের দূর্বল করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। বৃহস্পতিবার বিকেল ও রাতে অভিযানের সব প্রস্তুতি শেষে শুক্রবার ১০টার দিকে বড়হাটের ৩ তলার ওই বাড়িটির জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে সোয়াত টিম। ওই আস্তানায় অভিযানের আগে আশপাশের লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে মাইকিং করে পুলিশ। স্থানীয়দের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে থাকতে বলা হয়। অভিযানকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। অভিযানের সময় উৎসুক জনতা যাতে অভিযানস্থলে ভিড় করতে না পারে-সে বিষয়টি সকাল থেকেই তদারক করেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল। বড়হাটের ওই বাড়িতে অভিযানের সময় পুরো শহর জুড়ে নামে অজানা আতঙ্ক। সকালের দিকে শহরের কিছু দোকানপাট খোলা থাকলেও পরে বন্ধ হয়ে যায়। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তল্লাশি। শহরে যান চলাচলও কমে যায়। অতিপ্রয়োজন ছাড়া কেউ শহরে বের হয়নি। শুক্রবার সকাল পৌনে ৮ টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকালে ১০ টার দিকে অভিযান শুরু করে সোয়াত । সকালে বড়হাটে পৌঁছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে খবর রয়েছে এ জঙ্গি আস্তানায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক,একজন বোমা বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত জঙ্গি রয়েছে। সে কারণেই অপারেশন শেষ করতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। তখন তিনি জানান সিলেটের আতিয়া মহলের ঘটনার সূত্র ধরেই চিহ্নিত করা হয়েছে মৌলভীবাজারের বড়হাটের আস্তানা।এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ম্যাক্সিমাস’। ওই আস্তানায় অনেকগুলো কামরা রয়েছে। জনবলও রয়েছে একাধিক। দুপুর ১টার দিকে জঙ্গি আস্তানায় প্রবেশের জন্য আইনশৃংখলা বাহিনী বাড়ির পাশের গাছ কাটতে থাকে। এমন সময় সোয়াতের অভিযান মেক্সিমাস চলাকালিন সময় বাড়ি থেকে জঙ্গিদে ছোড়া বোমা বিস্ফোরিত হয়। এ সময় পুলিশ সদস্য কয়ছর (৩০) আহত হন। আহত কয়ছর মৌলভীবাজার ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভিতরে বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়। বোমার আঘাতে বাড়ির দেয়াল একটি অংশ ভেঙ্গে পড়ে বলে জানা যায়। বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে আবারও প্রচন্ড গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরিত হয়। জঙ্গি আস্তানার উপরে ধোয়া উড়তে দেখা যায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেস বিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম জানান আলোস্বল্পতার জন্য রাতে অভিযান স্থগিত থাকবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে সকালে ফের অভিযান শুরু করবে সোয়াত। শেষ দফায় অভিযানের জন্য শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে প্রস্তুতি নেয় পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াত। প্রায় ৩ ঘন্টা অভিযান শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন মনিরুল ইসলাম। ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ এ তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে তিনি জানান। এদের মধ্যে দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলা রয়েছে। নিহত তিন জঙ্গির একজন একজন সিলেটের আতীয়ার মহলের বোমা বিস্ফোরনের সাথে জড়িত ছিল বলে তিনি জানান। প্রেস ব্রিফিং কালে তিনি বাড়ির মালিকদের উদ্দেশ্যে করে বলেন বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় ভাড়াটিয়াদের সকল তথ্য নিশ্চিত করে আরো সতর্ক হয়ে ভাড়া দেওয়ারও পরামর্শ দেন। অভিযান শেষে শনিবার দুপুরে ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। প্রেসব্রিফিংয়ে সময় তার সাথে ছিলেন পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান,কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের ডিসি প্রলয় কুমার র্জোয়ারদার, সিলেটের এডিশনাল ডিআইজি নজরুল ইসলাম,মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালালসহ সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা থেকে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকায় একটি বাড়ি এবং শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে আরও একটি বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com