মৌলভীবাজারে বোরো ধানের বাম্পার ফলন : বন্যা ও ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা

April 21, 2021,

এস এম উমেদ আলী॥ অনুকুল আবহাওয়া ও পোকা মাকড়ের আক্রমন তেমন না থাকায় মৌলভীবাজারের হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎসবমূখর পরিবেশে মাঠ থেকে কৃষকরা হাসি মুখে পাকা বোরো ধান বাড়িতে তোলছেন। কৃষি বিভাগ বলছে গেল মৌসুমে ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় ২ হাজার ৮’শ ১৫ হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়েছে। তবে আগাম বন্যা ও ঝড়-বৃষ্টি সহ চলমান করোনা ভাইরাসে শ্রমিক সংকটে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। হাওর এলাকায় কৃষকদের উৎসাহ যোগাতে রাজনগর উপজেলার সুনাটিকি গ্রামে ধান কাটার উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। এ সময় উপস্থিত ছিলেনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ কাজী লুৎফুল বারী সহ কৃষি বিভাগের অন্যন্য কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষক।
অপর দিকে কৃষিবিদ কাজী লুৎফুল বারী প্রতিদিন কৃষকদের ধান কর্তনে উৎসাহ যোগাতে জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেরাচ্ছেন। বুধবার দূপুরে সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের মানিক হাওরে কম্বাইন্ড হারভেষ্টারে ধান কর্তন পরিদর্শনে যান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা কৃষি অফিসার সুব্রত কান্তি দত্ত সহ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষক।
দেশের অন্যতম প্রধান হাওর হাকালুকি সহ অন্যান্য হাওরে একযোগে মাঠ থেকে পাকা বোরো ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। ফলন ভালো হওয়া ও নতুন ধানের মৌ-মৌ গন্ধে যেন মূখরিত চারিপাশ। কৃষকরা মাঠ থেকে ধান সংগ্রহ করে অনেকেই মাঠে অথবা রাস্তার পাশে সেরে নিচ্ছেন মাড়াই কাজ। করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউন থাকায় রয়েছে কিছুটা শ্রমিক সংকট। এতে করে অতিরিক্ত মজুরী দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের। স্থানীয় কৃষকরা জানালেন গেল মৌসুমে ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় বোরো আবাদের জমির পরিমান তারা বৃদ্ধি করেছেন। তবে তারা হাইব্রিড ধানের বীজ সহ বালাই নাশকের ন্যায্য মূল্যে দাবী করেন।
হাকালুকি হাওর এলাকার ভুকশিমুল ইউনিয়নের হাওর এলাকার জাবদা গ্রামের আক্কল মিয়া জানান, তার নিজের জমি নেই ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ব্রি-ধান ২৯ চাষ করেছেন। ফলন গত কয়েক বছরের মধ্যে ভালো হয়েছে।
বাদে ভুকশিমইল এলাকার কৃষক বারিক মিয়া জানান, গেল মৌসুমে ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় বোরো আবাদের জমির পরিমান বৃদ্ধি করেছেন। গত বছর ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগান। মূল্য ভালো পাওয়ায় এবছর ৮ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। ফলনও তার জমিতে ভালো হওয়ায় খুশিতে ধান কাটছেন নিজের জমিতে।
হাকালকি হাওরের মীরশঙ্কর গ্রামের রমজান আলী জানান, ব্রি-ধান ২৯, ৮৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করেছেন ১৭ বিগা জমিতে। এ বছর খড়া ও পুকা-মাকড়ের আক্রমন না থাকায় ফলন ভলো হয়েছে। ৪ বিগা জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। ঝড় বৃষ্টি ও আগাম বন্যার না হলে অবশিষ্ট জমির ধান কাটতে আরও ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন হাইব্রিড ধানের ফলন ভালো হয়। কিন্তু বীজের মূল্য অত্যাধিক যা প্রতি কেজি কিনতে হয়েছে তার ৪ ‘শ টাকায়। পাশাপাশি সরকারি বিএডিসির ১০ কেজি বীজ মিলে ৪‘শ টাকায়। এ ছাড়াও বালাই নাষক ঔষধের দামও অনেক বেশী।
হাওর পাড়ের সাদিপুর গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া জানান, ৮ বিঘা জমিতে ধান রোপন করেছেন। রমজান ও বয়সের ভারে তিনি নিজে ধান কাটতে পারছেন না। ৫ জন ধান কাটার শ্রমিক লাগিয়েছেন। প্রতিদিন ৫‘শ টাকা হারে দিতে হচ্ছে। পৃথক ভাবে তাদের খাওয়া খরছ দিতে হয়। ৫ শ্রমিকে প্রতিদিন খাবারসহ খরচ কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। তারা ২ দিনে একবিঘা জমির ধান কাটলে বিঘা প্রতি খরচ হচ্ছে ৬ হাজার টাকা। এরপর ধান মাড়াইসহ অন্যান্য খরচ। এই ধানের উপর নির্ভরশীল তাদের ৬ জনের পরিবার। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রতি মন ধানে খরচ প্রায় হাজার টাকা।
বাদে ভুকশিমুল এলাকার কৃষক মোহাম্মদ আলী জানান, ব্রি-ধান ২৮,২৯ ও বিআর-১৪ (গাজী) ধান মিলিয়ে ১২ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। ফলন গত কয়েক বছরের তোলনায় ভাল হয়েছে। তবে ব্রি-ধান ২৮ এক বিঘা জমির কিছু ধান জ¦লে গেছে। তারপরও তিনি ফলনের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করেন।
জাবদা গ্রামের মোঃ আব্দুল কাদির জানান, ১২ বিঘা জমিতে ব্রি-ধান ২৯ চাষ করেছেন। তার জমিতে ব্লাস্ট রোগে আক্রন্ত হচ্ছে দেখে কৃষি বিভাগের ব্লক সুপার ভাইজাররের পরামর্শে ১২ বিঘার মধ্যে ৮ বিঘায় সময়মতো ঔষধ স্প্রে করায় ক্ষতি হয়নি। তবে অবশিষ্ট ৪ বিঘা জমিতে লকডাউনের কারণে ঔষধ সংগ্রহ ও স্প্রে করতে বিলম্ব হওয়ায় ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
হাকালুকি হাওর তীরের কুরবানপুর গ্রামের আছদ আলী, গৌড়করন গ্রামের আব্দুর রউফ, মহেষগৌরি গ্রামের আব্দুস সামাদ ও সাদিপুর গ্রামের জমসেদ আলী জানান, এবার তারা বিআর-১৪, ব্রি-৫৮, ব্রি-২৯, ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপন করেছেন। চৈত্র মাস থেকে বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন। তারা প্রত্যেকেই ৩ থেকে ৪ বিঘা জমির ধান কেটেছেন। ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে পূরো ধান ঘরে উঠাতে।
কৃষক সাদিক মিয়া বলেন, প্রায় প্রতি রাতেই বৃষ্টি হচ্ছে। বোরো ধান যেন আরও পোক্ত হয় সেজন্য অপেক্ষা করছেন অনেকে। কিন্তু বৃষ্টি দেখে ভয় লাগে। তবে কৃষি বিভাগের মাইকিং এর কারণে অনেকেই বোরো ধান কাটতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে বছর বোরো আবাদ হয়েছে জেলায় ৫৬ হাজার ৩‘শ ৪৫ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে ২ হাজার ৮‘শ ১৫ হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার সদরে ১০ হাজার ৫৩ হেক্টর, রাজনগর ১৩ হাজার ৬‘শ ৩০ হেক্টর, কুলাউড়া ৭ হাজার ৯‘শ ১২ হেক্টর, জুড়ী ৫ হাজার ৭ ‘শ ৭০ হেক্টর, বড়লেখা ৪ হাজার ৯‘শ ৪০ হেক্টর, কমলগঞ্জ ৪ হাজার ২‘শ ৮৮ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল ৯ হাজার ৬‘শ ৫২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
এছাড়াও গেল আমন ধানের চাষ হয়েছে জেলায় ১ লক্ষ ১ হাজার ৪’শ ৫০ হেক্টর জমিতে। গেল বছর (২০২০ সাল) আউস ধানের আবাদ হয়েছে ৫৫ হাজার ৪’শ ৪০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর আউস এর লক্ষ্য মাত্র ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৫’শ ৯৩ হেক্টর জমি।
২০১৯-২০২০ সালে জেলায় মোট খাদ্যের চাহিদা ছিল ৪ লক্ষ ৭ হাজার ১ শত ৩৬ মেট্রিক টন। গেল ৩ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ৬ লক্ষ ৩৮ হাজার ৪ শত ৬০ মেট্রিক টন। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৩ শত ২৪ মেট্রিক টন।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী জানান, আবহাওয়া অনুকুলে ও পুকা-মাকড়ের আক্রমন কম থাকায় এবছর বোরো ধানের বাম্পার ফল হয়েছে। ইতোমধ্যে বোরো ধান হাওর এলাকায় ৩৭ ভাগ ও হাওর ছাড়া ৮ ভাগ কর্তন হয়েছে। বর্তমানে আবহাওয়া অনুকুলে রয়েছে। আবহাওয়ার এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১৫-থেকে ২০দিনের মধ্যে পূরো ধান ঘরে তোলা সম্বব হবে।
তিনি আরও জানান, কৃষি বিভাগ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে চলতি বোরো মৌসুমে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ২৫ হাজার কৃষককে ৫০ কেজি হাইব্রিড জাতের বীজ বিনামূল্যে দেয়া হয়। পৃথক ভাবে ১ হাজর ৮’শ কৃষককে প্রণোদনার ১ কেজি করে হাইব্রিড বীজ ও সাথে সার সরবরাহ করা হয়। রমজান মাস থাকায় বোরো ধান কাটতে শ্রমিক সংকট যাতে না হয় তারজন্য চা বাগানের শ্রমিকদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মাঠে কম্বাইন্ড হারবেস্টার ও রিপার মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ঝড়-বৃষ্টির কারণে হাওরের বোরো ধানের ক্ষতি হতে পারে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল যেন নষ্ট না হয় সে জন্য বোরো চাষিদের দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য আগাম সতর্কতা জানিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে। বর্তমানে আউস ধানের জন্য প্রথম পর্যায়ে ১২ হাজার কৃষকদের প্রত্যেককে ৫ কেজি করে ব্রি-ধান ৪৮ বীজ ও ৩০ কেজি করে সার বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।
কৃষকদের দাবী সরকারি উদ্যেগে হাইব্রিড ধানের বীজ সহ বালাই নাশক, উন্নতমানের ধান মাড়াই মেশিন, ডিজেল ইঞ্জিন, পাওয়ার টিলার সহ খুচরা যন্ত্রাংশ কম মূল্যে সরবরাহ করা। পাশাপাশি বিদেশ থেকে উন্নতমানের কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, রাইস প্লান্টার মেশিন আমদানী করে ভুর্তুকির আওতায় না নিয়ে সরাসরি সকল কৃষকদের মধ্যে কমমূল্যে সরবরাহ করলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে।

 

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com