মৌলভীবাজারে হরতাল অবরোধে ক্ষতির মুখে পর্যটন শিল্প

December 9, 2023,

স্টাফ রিপোর্টার॥ হরতাল অবরোধের কারণে প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা ও চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারে পর্যটন শিল্প মাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় পর্যটক শুন্য হয়ে পড়েছে জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্থানগুলো। চলছে দর্শনীয় স্থানগুলোতে সুনসান নিরবতা। পাশাপাশি খালি পড়ে আছে আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট গুলো। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ছুটি সহ ছাটাই করছেন।

জানা গেছে, প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শুরুতে যখন কনকনে শীতের আগমনী বার্তা আসে ঠিক তখনি পর্যটকরা ভীর জমান সবুজে ঘেরা প্রকৃতির নানা রুপে সজ্জিত বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। তারা জেলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পরিবার পরিজন নিয়ে চষে বেড়াতেন প্রকৃতির অপরুপ দৃশ্য গুলো নিজ চোখে অবলোপন করতে। কিন্তু এ বছর পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে পর্যটকরা আসতে সাহস করছেননা।

মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে পযটকদের আকৃষ্ট করা এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইলহাওরসহ ছোট-বড় মিলিয়ে তিনটি বৃহৎ হাওর, উঁচুউঁচু টিলা বেষ্টিত চা বাগান, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী মেঠোপথ, ১২৫০ হেক্টর আয়তনের জীববৈচিত্র ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ অরণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ভারত সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, রোমাঞ্চে ভরা হামহাম জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গলের মহান স্বাধীনতার স্মৃতি বিজরিত বদ্ধভুমি, বাইক্কাবিল, বড়লেখা উপজেলায় মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, মনু ব্যারেজ, সাকেরা চা বাগান লেক, পাত্রখোলা লেক, রাজঘাট চা বাগান লেকসহ আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।

সর্বশেষ ৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেছে অলস সময় পার করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বুকিং ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২০ শতাংশ কক্ষ। অথচ শীতের মাসগুলোয় পর্যটন শিল্পে থাকে ভরা মৌসুম। এ ছাড়া সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির দিন গুলোতেও পর্যটকদের ভিড় থাকে। হোটেল-রিসোর্ট গুলোতে দেওয়া থাকে অগ্রিম বুকিং। খাবার রেস্টুরেন্ট গুলোতে থাকে উপচেপড়া ভিড়। মৌসুমের শুরুতেই জেলা জুড়ে এভাবে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ায় হতাশ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা পর্যটন শিল্পে এ ধসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রাজনৈতিক অস্থিরতাকে। নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে দেশের এমন অস্থির সময়ে মানুষ ভ্রমণ করতে অনিচ্ছুক। ডিসকাউন্ট সহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও পর্যটনের ভরা মৌসুমে প্রত্যাশিত সংখ্যক পর্যটক পাওয়া যাচ্ছে না-এমন মন্তব্য পর্যটন সংশ্লিষ্টদের। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও নিসর্গ নিরব ইকো কটেজের সত্ত্বাধিকারী কাজী শামসুল হক বলেন, এখন শীত মৌসুম শুরু। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষে বছরের এ সময় অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পর্যটক আসতেন। কিন্তু অবরোধ-হরতালের কারণে পর্যটক নেই বললেই চলে। আর পর্যটক শুন্য থাকায় আমাদের রিসোর্ট এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ক্ষতির মুখে। কারণ পর্যটক না এলেও হোটেলের নিয়মিত খরচ বহন করতে হচ্ছে। এ সংকট চলতে থাকলে আমরা অচিরেই পথে বসে যাবো। হরতাল অবরোধের কারণে অনেকেই ট্যুরে আসতে চাচ্ছেননা। কিছু পর্যটক আসছেন ট্রেনে আবার দিন শেষে তারা চলে যাচ্ছেন ট্রেনে করে।

শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের সত্ত্বাধিকারী সেলিম আহমেদ বলেন, গেল অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত বুকিং হয়েছিল। পরে ২৮ তারিখ বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্রকরে গন্ডগোল হলে সকল বুকিং বাতিল হয়ে যায়। তবে বিএনপির সমাবেশের তিন সপ্তাহ আগে পর্যটন শিল্প বেশ জমে ওঠেছিল। পরে হরতাল অবরোধের ঘোষনা আসলে চলতি পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই আমরা বিশাল আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হলাম। হরতাল অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারেণে স্টাফ ছাঁটাই করতে হয়েছে। এভাবে ভর্তুকি দিয়ে রিসোর্ট চালাতে থাকলে আমাদের পর্যটন শিল্পে ধস নেমে আসবে। বিশাল আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে না পারলে আমরা পথে বসে যাবো। কাজেই এ পর্যটন শিল্পের লোকসান পুষিয়ে ওঠতে আমরা সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনার দাবি করছি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল রেল ষ্টেশনে কথা হয় ঢাকার মুগদা এলাকা থেকে বেড়াতে আসা সাকির আহমদের সাথে। তিনি জানান ভোরে কমলাপুর স্টেশন থেকে আন্তনগর পারবত ট্রেনে করে তারা ২জন শ্রীমঙ্গলে আসেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক ও কয়েকটি চা বাগান গুড়ে দেখেন। বৃষ্টি থাকায় অনেক স্থানে যেতে পারেননি। প্রকৃতির এ অপরুপ দৃশ্য তাদের মুগ্ধ করেছে। ঢাকায় যাওয়ার জন্য বাস না পাওয়ায় ট্রেনের অপেক্ষা করছেন স্টেশনে।

কথা হয় আবুল কালাম নামের এক স্থানীয় এক পর্যটকের সাথে, তিনি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর এলাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী তার ভাইকে নিয়ে আসেন। তারা লাউয়াছড়া উদ্যান ও চা বাগান গুড়ে দেখেন, ওই স্থানগুলো একেবারে ফাঁকা ছিল। আসার সময় তিনবার সিএনজি অটোরিক্স পাল্টিয়ে আসতে হয় লাউয়াছড়ায়। এতে তাদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। অবরোধ না থাকলে এ সমস্যায় পরতেননা বলে জানান।

শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এলাকার পর্যটন ট্যুরিস্ট গাইড সাজু মারচিয়াং বলেন, বিগত বছরগুলোয় ডিসেম্বর মাসে দেশি-বিদেশী পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। হোটেল-রিসোর্টে থাকার জন্য আগে বুকিং না দিলে তাৎক্ষনিক কোনো সিট পাওয়া যেতনা। এখন এই হোটেল-রিসোর্ট ফাঁকা যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রতি বছর এ সময় দেশ-বিদেশের নানা বয়সী পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পট। কিন্তু টানা অবরোধ-হরতালের কারণে এবছর শীত মৌসুমের শুরুতে এসব স্পটে এখন পর্যটকদের দেখা মিলছে না। এতে করে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িতরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, লাউয়াছড়ার ইতিহাসে গেল ঈদে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন। তার পর থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পর্যটক সংখা বেশি ছিল। গেল নভেম্বর মাসের শুরুতে একবোরে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেল। যারা এসেছেন তারা স্থানীয় পর্যটক।

পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্বে থাকা ট্যুরিস্ট পুলিশ মৌলভীবাজার জোনের ওসি প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ায় পর্যটন পুলিশের অনেকেই আগাম ছুটি কাটিয়ে এসেছেন। পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তেমন কোনো পর্যটকের সমাগম হচ্ছেনা। তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় পূর্বের ন্যায় প্রস্তুত রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, প্রকৃতি মুখরিত এ জেলায় বেশ কিছু দৃষ্টি নন্দন পর্যটন স্পট রয়েছে। পর্যটন শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হচ্ছে। তাই  জেলাকে পর্যটক বান্ধব করতে কিছু প্রস্তাবনা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো সহ নানা মুখি উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যটকরা কিছু কম আসছেন। এটি এক সময় কাটিয়ে উঠবে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com