মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী নির্মূলে শ্বাসরুদ্ধকর ৮২ ঘন্টার অভিযান
![](https://i0.wp.com/www.patakuri.com/wp-content/uploads/2017/04/17761292_1665186677123336_502933195_o.gif?fit=800%2C445&ssl=1)
ইমাদ উদ দীন॥ রাতের বেলায় হঠাৎ জেলা পুলিশের কাছে তথ্য আসে মৌলভীবাজারে ঘাাঁট ঘেড়েছে জঙ্গিরা। সেদিন ছিল ২৯শে মার্চ বুধবার। ভোর রাতে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালালের নেতৃত্বে সকল অফিসার ও ফোর্সসহ প্রায় কয়েক শতাধিক পুলিশ সদস্য নিয়ে অভিযানে নামেন। জঙ্গি আস্তানার নির্দিষ্ট স্থান বড়হাটের লন্ডন প্রবাসী সাইফুল ইসলামের (সাইফুরের) বাড়ি। রাতেই ঘেরাও করে রাখা হয় ওই জঙ্গি আস্তানার পুরো বাড়ি। জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পেয়ে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান ছুটে আসেন বড়হাটের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের দিক-নির্দেশনা দিতে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় পুলিশ অবস্থান নিয়ে চালায় কৌশলী অভিযান। ঠিক ফজরের নামাজের আযানের সময় বাড়ির কেয়ারটেকার জুয়েলের নিকট থেকে জানা যায় একই মালিকের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুরস্থ বাসায় এরকম আরেকটি বাড়ি রয়েছে সেটিতেও জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। সাথে সাথে মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) মোঃ রওশনুজ্জামান সিদ্দিকীসহ ৩০-৩৫ জন পুলিশ সদস্য ও ওই বাড়ির কেয়ারটেকারকে নিয়ে প্রায় ২০কিলোমিটার দূরে নাসিরপুরের উদ্দেশ্যে দ্রুত রওয়ানা হন। ইতোমধ্যে বড়হাটের ঘেরাও করা জঙ্গিদের নিকট থেকে তথ্য পেয়ে ওই বাড়ির জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে পারে তাই দ্রুত সাথের অফিসার ও ফোর্সদের বাড়ি ঘেরাও করার নির্দেশ দিয়েই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ
রওশনুজ্জামান সিদ্দিকী ও তাদের বডিগার্ড, সঙ্গে থাকা কেয়ারটেকার এবং ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির এক ব্যক্তিসহ জঙ্গি আস্তানার চৌসীমানার ভিতরে ঢুকে পড়েন। এমতাবস্থায় ঘরের বাহিরে থাকা মহিলা জঙ্গি দ্রুতগতিতে ঘরে ঢুকে প্রচন্ড শব্দে ঘরের মূল ফটক বন্ধ করে দেয়। সাথে সাথে ঘরের ভিতর হতে মানুষের এদিক ওদিক ছুটাছুটির শব্দ শুনতে পান তারা। ঘরের ভিতরে কিসের শব্দ হচ্ছে এটা ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ জানালা দিয়ে এক জঙ্গি হাতে একটি গ্রেনেড নিয়ে তাদের (পুলিশ সদস্যদের) উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারতে উদ্যত হলে পুলিশ সুপার এর বডিগার্ড বিষয়টি লক্ষ্য করে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকেন “স্যার বোমা,বোমা”। তখন বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়া পুলিশ অফিসারসহ অন্যান্যরা দ্রুতগতিতে বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে সতর্ক অবস্থান হিসেবে চৌসীমার পাকা দেওয়ালের পাশে অবস্থান নেয়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হলেই জঙ্গিদের ছুড়ে দেয়া বোমাটি বিকট শব্দে বিষ্ফোরিত হয়। অল্পের জন্য রক্ষাপান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল ও অতিরিক্ত পুলিশ মো: রওশনুজ্জামান সিদ্দিকীসহ অন্যরা। এর পরপরই বাড়ির চারপাশে পুলিশ সদস্যরা নিঃñিদ্র পাহারাসহ গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। এর মধ্যেও ঘরের ভিতরে অবস্থানরত জঙ্গিরা আরো ৫-৭টি বোমা-গ্রেনেডের বিষ্ফোরণ ঘটায়। এমতাবস্থায় পুলিশ সুপার বড়হাটে আস্তানায় অবস্থানরত ডিআইজি কে জানান “স্যার আমরা আক্রান্ত হয়েছি, দ্রুত আরো ফোর্স পাঠান”। অতিরিক্ত ফোর্স আসার পূর্ব পর্যন্ত পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রওশনুজ্জামান সিদ্দিকী, বডিগার্ডসহ এই জঙ্গি আস্তানাকে ঘিরে রাখা জেলা পুলিশের সদস্যরা ওই জঙ্গি আস্তানার উপর গুলি বর্ষণ অব্যাহত রাখেন।পরবর্তীতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স এবং ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কয়েকজন অফিসার ও ফোর্স এসে ঘটনাস্থলে থাকা জেলা পুলিশের সদস্যদের সাথে যোগ দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় কাউন্টার এ্যাটাক করেন। ইতোমধ্যে রেঞ্জ ডিআইজি ও আইজিপি সহ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত সোয়াট টিমের সদস্যদের নাসিরপুরের পাঠানোসহ অভিযান পরিচালনা জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এরপর ঢাকা হতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলামসহ সোয়াট টিম সড়কপথে নাসিরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ সোয়াট টিম নাসিরপুরস্থ জঙ্গি আস্তানা নিয়ন্ত্রনে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রওশনুজ্জামান সিদ্দিকীসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা এই জঙ্গি আস্তানাটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্দিষ্ট বিরতিতে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখে ঘরের ভিতরে অবস্থানরত জঙ্গিদের অবরুদ্ধ রাখতে বাধ্য করেন। এরপর ঢাকার সোয়াট টিম ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করে সফল ভাবেই এই অভিযানের সমাপ্তি দেন। সোয়াটের অভিযান শেষে বম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা নিহত জঙ্গিদের রাখা অবিষ্ফোরিত বেশ কয়েকটি গ্রেনেড ও বোমা নিষ্ক্রিয় করেন।
পরবর্তীতে ওই জঙ্গি আস্তানায় সুইসাইডাল ভেস্ট পরিহিত গ্রেনেড বিষ্ফোরণের মাধ্যমে আতœহননকৃত ৭(সাত) জঙ্গির ছিন্ন-ভিন্ন দেহ ও অন্যান্য আলামত সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা পরবর্তী আইনী প্রক্রিয়ার জন্য সংরক্ষণ করেন। এ দুটি ঘটনায় মৌলভীবাজার সদর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি মামলা রুজু হয় এবং নিহত অজ্ঞাতনামা জঙ্গিদের নাম পরিচয় তাদের আতœীয়-স্বজন কর্তৃক শনাক্ত করা হয়। তারা নিজেরা দেশ দ্রোহী ওই জঙ্গিদের লাশ নিতে চাননি। তাই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে মৌলভীবাজার পৌরসভার কাছে দাফনের জন্য মরদেহ গুলো হস্তান্তর করা হয়। সিলেটের আতীয়ার মহলের বাহিরের ঘটনার যাতে পু:রাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য পুলিশ সুপার নিজেই হ্যান্ড মাইক যোগে ওই এলাকার বাহিরে উৎসুক লোকজনের জটলা এড়াতে সতর্কতার ঘোষণা দিতে থাকেন। জেলা পুলিশের সকল সিনিয়র,জুনিয়র অফিসার ও সদস্যদের ৮২ ঘন্টার রুদ্ধশাস অভিযানে বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া সম্পন্ন হয়। দীর্ঘ সময় পর কৌতুহল আর উদ্বেগ উৎকন্ঠার অবসান হয় দেশবাসীর। আর প্রাণ ফিরে আসে মৌলভীবাজার জেলা বাসির। এতবড় একটি অভিযানের সফল সমাপ্তিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মৌলভীবাজার বাসী জেলা পুলিশসহ অভিযানে থাকা অন্যান্য সদস্যদের অভিনন্দন জানান। অভিযানের জন্য ওই এলাকার জন সাধারণ ১৪৪ ধারার কারনে অনেকেই কষ্ট সহ্য করে পুলিশকে সহযোগীতা করার জন্য জেলা পুলিশ পক্ষ থেকে পুলিশ সুপার সবার কৃতজ্ঞতা জানান।
মন্তব্য করুন