যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বছর বয়সে গ্রাজুয়েশন করা আলোড়ন সৃষ্টিকারী কায়রানকে নিয়ে মৌলভীবাজারে আনন্দ উচ্ছ্বাস
মু. ইমাদ উদ দীন॥ গোটা বিশ্বজুড়ে তাঁর প্রতিভার প্রখরতা নিয়ে চলছে তোলপাড়। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই গ্রাজুয়েশন শেষে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকুরি। তাও আবার সেই চাকুরিও বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান ইলন মাস্কের মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্পেস-এক্স এ।
বিশ্বে আলোড়ন ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী চোখছানাবড়া হওয়ার মতো তাঁর বাস্তবিক এমন গল্প এখন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত কায়রান আমান কাজীর নানা বাড়ির শহরেও। মৌলভীবাজার জেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্র চৌমুহনা এলাকায় জুলিয়া শপিং সিটি।
মায়ের নামের ওই শপিংসিটির ৩য় তলায় কায়রানের নামেই একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট। এই মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট শহরের সবার কাছে পরিচিত। এখন ওই পরিচিতিতে নতুন সংযোজন ছোট্ট কায়রানের বিশাল অর্জন। ১৪ বছর বয়সেই গ্রাজুয়েশন।
একই সাথে বিশ্বের সুনামধন্য স্পেসএক্স-এ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকুরি। কায়রানের এমন অর্জন এখন বিস্ময় বালক উপাধিতে তাঁর সুনাম ও পরিচিতি বিশ্ব জুড়ে। বিদেশের নামিদামী গণমাধ্যমেও গুরুত্ব দিয়ে স্থান পাচ্ছে তাঁর এমন অর্জনের সংবাদ।
এমন খবরে মৌলভীবাজার জেলা জুড়ে তরুণ প্রজন্মসহ সবার মুখে মুখে গর্বের আলোচনা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে তাঁকে অভিনন্দন জানানোর জোয়ার। বাবার বাড়ি ঢাকার গুলশানে থাকা স্বজন আর নানা বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখালকুলাউড়া ইউনিয়নের চৌধুরী বাড়ি ও শহরের বাড়িতেও বইছে আনন্দের বন্যা।
জুলিয়া কাজী ও মোস্তাহিদ কাজী দম্পত্তির একমাত্র সন্তান কায়রান আমান কাজী। বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। তাঁর বাবা ও মায়ের পরিবারের সদস্যরা সমভ্রান্ত।
দাদা প্রয়াত হালিম কাজী ফরেন সার্ভিস শেষে বুয়েটে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। দাদী ছালমা কাজী আদর্শ গৃহিণী। আর নানা ছিলেন মৌলভীবাজার জেলার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মরহুম গজনফর আলী চৌধুরী।
নানী সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য সৈয়দা হাছনা বেগম। কায়রানের বাবা পেশায় প্রকৌশলী আর মা আছেন ইনভেস্ট ব্যাংকিংয়ে। জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির গড় বয়স ১৭ থেকে ১৯ বছর। খুব মেধাবী হলে ১৫ বা ১৪ বছর তবে এই পরিসংখ্যানও খুবই কম।
সেখানে কায়রান ক্যালিফোর্নিয়ার লাস পজিটাস কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। আর সেখানে পড়েছেন গণিত ও রসায়ন বিষয়ে। আর স্যান্টা ক্লারা ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সম্পন্ন করেছেন ব্যাচেলর ডিগ্রি।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের প্রতিষ্ঠার ১৭২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কেউ কম বয়সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করলেন। ১৮ জুন স্যান্টা ক্লারা ইউনিভার্সিটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কায়রান তাঁর গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট গ্রহণ করবেন একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে।
ইতিমধ্যে সিটি কাউন্সিলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আনুষ্ঠানিক অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। জানা যায় কায়রান তৃতীয় গ্রেডে থাকাকালীন অবস্থায় তাঁর প্রতিভার প্রখরতা সবাইকে নাড়া দেয় ও আশ্চর্য করে। দেশ ও আর্ন্তজাতিক নানা বিষয়ে ক্লাসে শিক্ষকদের নানা যৌক্তিক প্রশ্ন করে ভড়কে দেন।
শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সবার কৌতুহল এটা কি করে সম্ভব। তখন ডাক্তাররাই পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন তাঁর আইকিউ কোয়ালিটি ৯৯.৯ শতাংশ। এমন তথ্য জানার পর তাঁর প্রতি যত্ন নিয়েছেন ও যথাযত গুরুত্ব দিয়েছেন মা,বাবা ও পরিবারের সদস্যরা।
চেহারার সৌন্দর্যতায় কায়রান যেমন আর্কষণীয়। তেমনি মেধায়ও। আর বাড়তি হলো তাঁর সমবয়সী ও সহপাঠীদের সাথে সহজেই আপন করে মিশে যাওয়ার গুণ।
মেধাবী কায়রান দুরন্তপনায় অন্যদেরকেও ছাড়িয়ে। দাদা,বাবা আর মায়ের মতো পড়ালেখায় মনযোগি হলেও পাশাপাশি খেলাধূলা টেলিভিশন দেখাও তাঁর নিয়মিত অভ্যাস।
নানা ও নানীর মতো রাজনীতি নিয়েও আগ্রহের কমতি নেই তাঁর। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে টেলিভিশনে নিয়মিত দেখছেন পলিটিক্যাল টকশো। সাত বছর বয়সেই কম্পিউটার বিজ্ঞানে পারদর্শী কায়রান পাইথন ল্যাংগুয়েজ ও মেশিন লার্নিংয়ে দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হন।
জুলাই থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে স্পেসএক্সের কার্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আনুষ্ঠানিক বড় পরিসরে চাকুরি জীবন শুরু হবে কায়রানের। বয়সে ছোট থাকায় পরিবারের সবাই তাঁর সাথে থাকবেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। স্পেস-এক্স এ যোগ দিতে পারায় কায়রান মহাখুশি।
নিজেও কিছু একটা আবিষ্কার করতে চান কায়রান। লেখাপড়ার পাশাপাশি তাঁর আগ্রহ মার্শাল আর্টস,পিয়ানো বাজানো ও ভিডিও গেমসে। বাস্কেটবল, নৃত্য ও কৌতুক বলে হাসানোও ভালোলাগে। ভালো বই পেলে সবকিছুই ভুলে বইয়ে মজেন কায়রান।
সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতেও যথেষ্ট পটু। নিজের বয়সের গন্ডির বাহিরে বন্ধুত্ব তৈরি এবং পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যকলাপও পছন্দ।
স্যান্টা ক্লারা ইউনিভার্সিটিতে একজন একাডেমিক এবং সামাজিক প্রিয় ব্যক্তিত্ব কায়রান। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মাতৃভাষা বাংলা বলাটাও অনেকটাই রপ্ত করেছেন কায়রান।
দাদা ও নানার স্মরণে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন কায়রান। প্রসঙ্গ উঠলেই বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ আগ্রহ তাঁর। কায়রান কাজীর মা জুলিয়া কাজী গণমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যে জানান দুই বছর বয়সেই কায়রান গুছিয়ে যৌক্তিক কথাবার্তা বলতে শিখেন।
ওই বছরই তার প্রি-স্কুল শুরু হয়ে যায়। ওর যখন আড়াই বছর বয়স তখন মিশরে ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলন চলছিল। অতটুকু ছেলে সেই ওই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নানা স্লোগান সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে।
ওর প্রাইমারি ডাক্তারকেও এই বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা জানায়। ডাক্তারও তখন অবাক হন। এতটুকুন শিশু সে অন্য দেশের আন্দোলন নিয়ে চিন্তা করছে।
ডাক্তার ওইদিন বাবা মাকে জানান এমন শিশু ব্যতিক্রমী ওর মতো প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষকে গাইড করাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ।
কায়রান গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে রসিকথা করে বলেন, সবাই জানতে চায় আমি অসাধারণ মেধাবী কি না। আমিতো আসলে সবসময়ই স্বাভাবিক তাই এটা বুঝি কি করে। আমার মা-বাবা বিষয়টিকে দেখেন তারাই বুঝেন। আমার মা বলেন তিনিই একমাত্র জিনিয়াস।
কারণ ঘরের সবকিছু তিনিই সামলে রাখেন। মা আরও বলেন আইকিউ বা বুদ্ধি সন্তানরা পায় মায়ের এক্স ক্রোমোজোম থেকে। বাবা তখন চোখ পাকিয়ে টিপ্পনি দেন।
মা-বাবার এই চমৎকার খুনসুটিতে পরিবারে আমার সময়টা কাটে বেশ আনন্দেই। বাবা, মা, নানী ও দেশে থাকা স্বজনরা তাঁর অব্যাহত সাফল্যের জন্য সবার দোয়া চেয়েছেন।
মন্তব্য করুন