শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র চা জাদুঘর

June 11, 2023,

এহসান বিন মুজাহির॥ চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত টি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের অংশ বিশেষসহ ব্রিটিশ শাসনামলে চা বাগানে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ব্রিটিশ বাংলোয় ব্যবহৃত শতাধিক আসবাপত্র, চা প্রসেসিং যন্ত্রপাতি, চা বাগানের ম্যানেজার ও চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত জিনিস, প্রাচীন রৌপ্য ও তাম্য মুদ্রাসহ বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন স্থান করে নিয়ে চা জাদুঘরটিতে।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ভানুগাছ সড়কের পাশে অবস্থিত ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড টি মিউজিয়াম’। রোববার ১১ জুন দুপুরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টি মিউজিয়ামের চারটি কক্ষে দেড়শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা স্মারকের মাধ্যমে।

চারটি কক্ষের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় কক্ষটি হচ্ছে প্রথমটি। এ কক্ষের বড় একটি অংশজুড়ে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত একটি কাঠের চেয়ার এবং একটি টেবিল।

১৯৫৭-৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্থান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে শ্রীমঙ্গলের নন্দবাড়ি চা বাগান পরিদর্শনে আসেন। তৎকালিন সময়ে বঙ্গবন্ধু যে চেয়ারে বসে মিটিং করেছিলেন সেই চেয়ারটি অতিযত্ন সহকারে রাখা হয়েছে এখানে।

রাখা হয়েছে মিটিংয়ের সেই টেবিলটিও। চেয়ার বরাবর দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। টেবিলের পেছনে সাদা পাঞ্জাবি এবং পাজামা পরিহিত বঙ্গবন্ধু ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। টেবিলের এক কোণায় লেখা রয়েছে, ১৯৫৭-৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তিনি এই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেছিলেন।

এছাড়া প্রতিটি কক্ষেই চা-গাছের গুড়ি ও কাচের ফ্রেম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট কয়েকটি টেবিল এবং কাচের ফ্রেম। এসব টেবিলের ওপরে এবং ফ্রেমের ভেতরে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের আসবাব সামগ্রি ও যন্ত্রপাতি।

কাঠ দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে পাথরে রূপান্তরিত চার খণ্ড জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হয় একটি যুদ্ধবিমান। সেই যুদ্ধবিমানের অংশ বিশেষও সংরক্ষিত রয়েছে টি মিউজিয়ামে।

টি মিউজিয়ামে সর্বমোট চারটি কক্ষ রয়েছে। বিভিন্ন কক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ব্যবহৃত রৌপ্য তাম্র মুদ্রা, নেপচুন চা বাগান থেকে সংগৃহিত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত মাঝারি ফ্রিজ, মাথিউড়া চা বাগান থেকে প্রাপ্ত হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেট, ব্রিটিশ আমলের যান্ত্রিক লাঙ্গল, পানির ফিল্টার, ব্রিটিশদের ব্যবহৃত টেলিফোন সেট, লিফট পাম্প, জরিপ ছিকল, টারবাইন পাম্প।

আরও রয়েছে ব্রিটিশ আমলের সার্ভিস বুক, সিরামিক জার, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, প্রনিং দা, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রসেসিং যন্ত্রপাতি, কম্পাস, ঘড়ি, চা গাছের মোড়া ও টেবিল, খাট, টেবিল, পাথর হয়ে যাওয়া আওয়াল গাছের খণ্ড, প্রোনিং দা, প্লান্টিং হো, কাটা কুদাল, টাইপরাইটার, পাথরের প্লেট, প্রনিং নাইফ, ইলেকট্রিক ফ্যান, দিকনির্ণয় যন্ত্র।

ফসিল, লোহার পাপস, ঘটি, ব্রিটিশ আমলের পাখা, ফর্ক, সার্ভে চেইন, রেডিও, সিরামিক ঝাড়, ডয়ারের অংশ, বাট্টার ডিল, রাজনগর চা-বাগানের নিজস্ব কয়েন, ব্রিটিশ আমলে লন্ডন থেকে আনা ওয়াটার ফিলটার, গাড়ির চেসিস, ট্রাক্টরের লাঙলের অংশ, বাগান পাহারার কাজে নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যবহৃত তীর-ধনুক, দিক নির্ণয়যন্ত্র, চা বোর্ডের হিসাবরক্ষকের ব্যবহৃত টাকা রাখার বাক্সসহ টেবিল।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম কম্পিউটার ও টাইপ রাইটার, চা তৈরির যন্ত্রসহ কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত আসবাব সামগ্রি, ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত খুন্তি, চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল, রিং কোদাল, চা- গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃত কলম দা, চয়ন যন্ত্র, কাটার, কোদাল, ত্রি-ফলা টাইপের কোদাল, মহিলা শ্রমিকদের ব্যবহৃত মাদুলী, নুপুর, ঝুমকা, নানা ধরনের রুপার গহনা।

 ব্রিটিশ আমলে শ্রমিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ার, পাথরের প্লেট, লোহার পাপোশ, ব্রিটিশ সাহেবদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃত প্রাচীন বেতারযন্ত্র, দেয়াল ঘড়ি, চা-বাগানে চারা লাগানোর কাজে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্র, বিভিন্ন ধরণের কলম ইত্যাদি।

এছাড়াও ব্রিটিশ আমলে যেসব বিজ্ঞাপন তৈরি করা হতো, সেই পোস্টারগুলোও রাখা হয়েছে একটি কক্ষের দেয়ালে টানিয়ে। চা জাদুঘরের পাশে চমৎকার একটি টি রিসোর্টও রয়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সুত্রে জানা যায়, চা বাগানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে এবং ব্রিটিশ আমলে চা-বাগানগুলোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এ শিল্পের ঐতিহ্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে টি মিউজিয়াম এর উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা টি মিউজিয়াম দেখতে আসেন। টি মিউজিয়ামের টিকিট কাউন্টারের সুত্রে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি।

জনপ্রতি প্রবেশ ফি ২০ টাকা দিয়ে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন এখানে। আরও জানা যায়, ছুটির দিনে এই জাদুঘরে প্রায় অর্ধশত পর্যটক আসেন। অন্যান্য দিনে দর্শনার্থী আসেন, তবে সংখ্যায় কিছুটা কম।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে চা-বাগানের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো দেখেন।

তাঁদের কাছে মনে হয়েছে পুরোনো জিনিস, একসময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্ম এসব দেখতে পাবে না। এই বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই তাঁরা এই চা জাদুঘরটি তৈরি করেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একসময় চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, এটা অনেকেই জানেন না। এই জাদুঘরটিকে আরো উন্নত এবং ব্যাপক পরিসরে করার জন্য পরিকল্পনা করছেন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com