শ্রীমঙ্গলে ৫ দিন আগেই একটি মন্ডপে শুরু হয়ে গেছে দূর্গা পূজা

October 15, 2023,

বিকুল চক্রবর্তী॥ শুক্রবার ২০ অক্টোবর থেকে সনাতন ধর্মালম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গোৎসব শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও ইউনিয়নের ইছামতি চা বাগানের মঙ্গলচন্ডির থলীতে রোববার ১৫ অক্টোবর থেকেই শুরু হয়েছে আগাম দুর্গাপূজা।

এই মুহুর্তে দেশের অনান্য মন্ডপগুলোতে যখন চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ ঠিক সেই সময় শ্রীমঙ্গলের শ্রী শ্রী মঙ্গলচন্ডী থলির পূজা মন্ডপ ঢাকের বাদ্যে ও উল্লুধ্বণিতে মুখরিত।

বৈদিক রীতি অনুযায়ী দেবী দূর্গার ৯টি রূপের পৃথক পৃথক প্রতিমা তৈরী করে এখানে ৯ দিনব্যাপী পূজা করা হচ্ছে এ মন্ডপে।

পূজার প্রধান পুরহিত (অব:) শিক্ষক দীপংকর ভট্টাচার্য্য জানান, রোববার করা হয় দেবীর শৈলপুত্রী রুপে পূজা। সোমবার ১৬ অক্টোবর হবে ব্রম্মচারিণী রুপে এরপর একেক দিন চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কাল রাত্রী, মহা গৌরী, সিদ্ধিদাত্রী রুপে ৯দিন ব্যাপী পূর্জাচনা হবে। দশমী দিন হবে বিসর্জন।

নবদুর্গা পূজা কমিটির সভাপতি পরিমল ভৌমিক জানান, বিগত ১৪ বছর ধরে শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন দেবস্থলী শ্রী শ্রী মঙ্গল চন্ডীর থলিতে তারা এ আয়োজন করে আসছেন।

তিনি জানান, তাদের মন্ডপে প্রতিদিন মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আসুরিক শক্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি বিশ^ শান্তি কামনায় দেবী দূর্গার কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। শ্রীমঙ্গল থানা অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার জানান, শ্রীমঙ্গলের প্রত্যেকটি পূজামন্ডপে একজন করে এসআই, সাদা পোষাকে পুলিশ ও আনসার সদস্য সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

এদিকে দেশের একমাত্র এই মন্ডপেই দেবী দূর্গাও ৯টি রুপে আরম্বও ভাবে পূজা করায় এখানে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষের ভীড় হয়।

দেবী দূর্গা যেন  জগতের অশুভ শক্তি দুর করে ভক্তের মনোবাঞ্চা পূর্ণ করেন এমটাই প্রার্থনা পূর্ণার্থীদের।

রোববার হবিগঞ্জ থেকে এই পূজা দেখতে আসা ভক্ত রীনা রানী দেব জানান, এই মন্ডপটি খুবই জাগ্রত। এটি প্রায় ৫শত বছরের পুরাতন দেবস্থলী।

এখানে একমনে মা দূর্গার কাছে কিছু চাইলে ফল পাওয়া যায়। এদিকে এই বিশেষ পূজাকে সামনে রেখে পূজা প্রাঙ্গনে বসেছে মেলা।

নবদুর্গা পূজা কমিটির  আয়োজক সুরঞ্জিত দাশ ও টুটু দেব জানান, শত শত বছরের প্রাচীন এই দেবস্থলি। যেখানে দেবী মঙ্গলচন্ডী জাগ্রত। দেশের বিভিন্ন প্রান্থ থেকে ১২ মাসই এখানে ভক্ত সমাগম ঘটে। বিগত ১৪ বছর ধরে পৌরানিক রীতি অনুযায়ী এখানে নবদুর্গার পূজার আয়োজন করে আসছেন তারা।

মন্ডপের সাজ সজ্জার দায়িত্বে থাকা বিপ্লব দেব জানান, এই মন্দিরটি জাগ্রত একটি মন্দির। যার নাম শ্রী শ্রী মঙ্গল চন্ডী মন্দির। অনেকে মনে করেন শ্রী শ্রী মঙ্গল চন্ডী থেকেই শ্রীমঙ্গল নামের উৎপত্তি।

তিনি বলেন, মায়ের আজ্ঞায়ই বাংলাদেশে একমাত্র এই মন্দিরে নব রূপে দেবী দুর্গা মায়ের পূজা হয়। এই পূজা মন্ডপের অপর পুরহিত দয়াময় ভট্টাচার্য্য জানান, মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আসুরিক শক্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি  বিশ^ শান্তি কামনায় দেবী দূর্গার কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

তিনি জানান, মা দূর্গার নব রূপের প্রথম রুপ হলো শৈলপুত্রী পর্বত রাজ হিমালয়ের গৃহে জন্ম হয় বলে তাঁর নাম হয়  শৈলপুত্রী। বৃষভের পৃষ্ঠে তিনি আরোহিত। শৈলপুত্রী দেবীর দক্ষিণহস্তে ত্রিশূল এবং বাম হস্তে কমলপুষ্প। তিনি পূর্বজন্মে ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতির কন্যা ছিলেন। তখন তার নাম ছিল সতী।

শৈলপুত্রী দুর্গার মহত্ব ও শক্তি অনন্ত। নবরাত্রি পূজার প্রথম দিনেই দেবীর পূজা ও আরাধনা করা হয়। উপনিষদের কাহিনী অনুসারে ইনি হৈমবতী রূপে দেবতাদের গর্ব চূর্ণ করেছিলেন।

ব্রহ্মচারিণী দেবি দুর্গার দ্বিতীয় রূপ হলো ‘ব্রহ্মচারিণী।’ ব্রহ্ম শব্দের অর্থ  হলো তপস্যা। অর্থাৎ মা দুর্গা এখানে ব্রহ্মচারিণী তথা তপশ্চারিণী অর্থাৎ তপ আচরণকারী। দেবী ব্রহ্মচারিণী ডানহাতে জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে আছেন।

পূর্বজন্মে যখন তিনি হিমালয়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন তখন নারদের পরামর্শে মহাদেবকে পতিরূপে লাভ করার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। এই কঠোর তপস্যার জন্য তাঁকে তপশ্চারিণী বা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়।

ত্রিলোকে দেবীর এই কঠোর তপস্যার জন্য দেবতা ঋষি সিদ্ধগণ সকলেই ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন। অবশেষে ব্রহ্মা দেবীর এইরূপ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দৈববাণী করলেন, হে দেবী এখন পর্যন্ত তোমার মত এরূপ কঠোর তপস্যা আর কেউ করেনি। তোমার স্তবে আমি সন্তুষ্ট। তোমার মনোস্কামনা পূর্ণ হবে ও মহাদেবকেই তুমি পতিরূপে পাবে। এবার তুমি গৃহে ফিরে যাও। সিদ্ধি লাভের পর তিনি দেবাদিদেব মহাদেব এর পতি হন।

তাঁর উপাসনায় ত্যাগ, বৈরাগ্য, সদাচার, সংযম বৃদ্ধি পায়। কঠিন সংঘর্ষেও দেবীর আরাধনায় সিদ্ধি ও বিজয় প্রাপ্তি হয়। এ থেকে ধর্য্য, ত্যাগ ও সংযমী হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়।

চন্দ্রঘণ্টা দেবী দুর্গার তৃতীয় রূপ। নবরাত্রি আরাধনার তৃতীয়দিন এর বিগ্রহকেই পূজার্চনা করা হয়। দেবীর মস্তকে ঘণ্টার আকারে অর্ধচন্দ্র শোভা পায়, তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা বলা হয়। এই দেবী দশভূজা। দেবীর দশ হস্ত নানান অস্ত্রে বিভূষিত।

দেবীর বাহন সিংহ, দেবীর কৃপায় সাধকের সমস্ত পাপ ও বাধাবিঘ্ন দূর হয়। মাতা চন্দ্রঘণ্টার উপাসক যেখানেই যান তাঁকে দেখে মানুষ শান্তি ও সুখ অনুভব করে। তাঁর আরাধনা করলে সংসারের দুঃখকষ্ট বিপদ-আপদ সব দূরীভূত হয়।

কুষ্মাণ্ডা‘ :- ‘কুষ্মাণ্ডা’ দেবী দুর্গার চতুর্থ রূপ। ইনিই হলেন জগতের আদি-স্বরূপা, আদি শক্তি। পুরানে বর্নিত আছে যখন চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, জগৎ সংসারের কোন অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক সেই গুরুর্ত দেবী ঈষৎ হাসো বিশ^ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন।

স্বল্পহাস্যে অণ্ড বা ব্রহ্মাণ্ডকে উৎপন্ন করায় দেবী কুষ্মাণ্ডা নামে অভিহিত হন। দেবী কুষ্মাণ্ডা অষ্টবাহু সমন্বিতা। তাই তিনি অষ্টভুজা নামেও খ্যাত। দেবীর সাতটি হাতে যথাক্রমে কমণ্ডলু, ধনুক, বান, পদ্মফুল, অমৃতপূর্ণ কলস, চক্র এবং গদা ধারণ করে আছেন, অপর একটি হাতে রয়েছে সকল সিদ্ধি এবং নিধি প্রদানকারী জপমালা। মাতা কুষ্মাণ্ডার উপাসনা করলে সমস্ত রোগ-শোক দূর হয় এবং আয়ু, যশ, বলবৃদ্ধি হয়। দেবী সামান্য সেবা-ভক্তিতেই প্রসন হন।

স্কন্দমাতা :- দেবী দুর্গার পঞ্চম রূপটি হলো ‘স্কন্দমাতা’। ‘কুমার কার্তিক’-এর অপর নাম ভগবান স্কন্দ। এই স্কন্দের মাতা হওয়ায় দেবী দুর্গার পঞ্চম রূপকে স্কন্দমাতা নামে অভিহিত করা হয়। স্কন্দমাতা দেবী চতুর্ভুজা। প্রতিমায় তার ডানদিকের  উপরের হাতে স্কন্দকে ধরে আছেন, নীচের হাতটি উপর দিলা করে পদ্মফুল ধারণ করে আছেন। দেবী শুভ্রবর্ণা এবং সিংহের উপরে উপবিষ্ঠা। কন্দমাতাকে ভক্তি সহকারে আরাধনা করলে ভক্তের মনো ইচ্ছা তিনি পূর্ণ করেন।

 কাত্যায়নী :-“মা দুর্গার ষষ্ঠ রূপটি হলো কাত্যায়নী। কত’ নামে এক বিখ্যাত মহর্ষির পুত্র ঋষি কাত্য ছিলেন আরো একজন মহর্ষি। মহর্ষি কাত্যায়ন সেই ‘কাত্য গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু বছর ধরে ভগবতী দুর্গা মাকে তার কন্যা রুপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেন। ভগবতী মা তাঁর এই প্রার্থনা পূরণ করেন। কাত্য এর কন্যা রূপে জন্ম গ্রহন করেন এবং তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী। ভক্তি সহকারে শুদ্ধচিত্তে দেবীর আরাধনা করলে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ রূপ ফলপ্রাপ্ত হয়। রোগ-শোক ও ভয় দূর্রীভূত হয়।

কালোরাত্রী :- দেবী দুর্গাও সপ্তম রুপটি হলো কালরাত্রী। ঘন অন্ধকার অমানিশার ন্যায় কালো দেবীর বর্ণ।

এই দেবী চতুর্ভূজা। ভয়ঙ্কর মুর্তিমতী দেবী হলেও তনি সব সময় শুভ ফল প্রদান করে থাকেন। সুতরাং দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে ভক্তদের কোনরকন ভীত বা আতংকিত হবার কারণ নেই।

এই দেবী কালরাত্রি দুষ্টের বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যারা দেবীর নিকট মনেপ্রাণে কোনো কামনা করেন, দেবী তার আশা পূর্ণ করেন। দেবীর উপসনায় অগ্নি-জল-জন্তু-শত্রু ও রাত্রিভয় থাকে না। সকল প্রকার ভয়মুক্ত হয়ে  ভক্ত সুখে শান্তিতে জীবন ধারণ করেন।

মহাগৌরী :- শ্রী শ্রী দুর্গার অষ্টম রূপ হলো ‘মহাগৌরী’ । দেবাদিদেব শিবকে পাওয়ার জন্য দেবী পারবতী রূপে কঠোর আরাধনা শুরু করেন। আরাধনার সময় তিনি কালো বর্নের হয়ে পড়েন। দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর এই কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে  তাঁকে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করান, তখন তার শরীর বিদ্যুৎ প্রভার ন্যায় কান্তিমান গৌরবর্ণ ধারণ করে। এরপর থেকেই তিনি মহাগৌরী নামে অভিহিত হন।

তিনি পতিরুপে দেবাদিদেবকে লাভ করেন। দেবীর গাত্রবর্ণ সম্পূর্ণ গৌর। বসন ভূষণও শ্বেতবর্ণের।  দুর্গাপূজার অষ্টম দিনে দেবীর পুজা পাঠ করা হয়। দেবীর আরাধনা ভক্তের জন্য জগতের জন্য কল্যাণকর। দেবীকে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতে পারলে অলৌকিক সিদ্ধিলাভ হয়, ভক্তের সকল – দৈন্য, পাপ-সন্তাপ দূও হয়। তার পবিত্র ও অগয় পুণ্যের অধিকারী হয়।

সিদ্ধিদাত্রী :-দেবী দুর্গার নবম রূপ হলো ‘সিদ্ধিদাত্রী’। তিনি সর্বপ্রকার সিদ্ধি প্রদান ক থাকেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আট প্রকার সিদ্ধিরকথা উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডে আর দশ প্রকার অর্থাৎ মোট আঠারো প্রকার সিদ্ধির কথা উল্লিখিত আছে।

মাতা সিদ্ধিদাত্রী ভক্তগণের এইসব সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন। নবদুর্গার মধ্যে মাতা সিদ্ধিদাত্রী হলেন দেবী দুর্গার অন্তিম রূপ। ভক্তি সহকারে দেবীর আরাধণা করলে ভক্ত সিদ্ধিপ্রাপ্ত হন।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com